নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ৫টি বড় পরিবর্তন

Looks like you've blocked notifications!
নাইন-ইলেভেন হামলার পর থমকে যায় পুরো বিশ্ব। ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, যোগাযোগব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে অতর্কিত প্লেন হামলা মার্কিনিদের মনে গভীর দাগ কাটে। কেউ কখনও ভাবতেও পারেনি, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে এত বড় সন্ত্রাসী হামলা ঘটানো সম্ভব।

নাইন-ইলেভেনের ওই সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের বহু ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসবিষয়ক বিখ্যাত ওয়েবসাইট হিস্ট্রি ডটকম এমন পাঁচটি দিক তুলে ধরেছে।

১. সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু

নাইন-ইলেভেন হামলার পর ২০ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসে এক ভাষণে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কিন্তু এখানেই তা শেষ হবে না। সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পতনের আগে এ লড়াই শেষ হবে না।’

এরই অংশ হিসেবে ২০০১ সালের শেষদিকে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় মার্কিন সেনাবাহিনী। আফগানিস্তানে যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের ইতিহাসে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান ও কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদাকে নির্মূলে এবং ৯/১১ হামলার কথিত নকশাকারী ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার এই যুদ্ধে সহযোগী হিসেবে অংশ নেয় ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটো। এতে সে সময় মার্কিনিরাও ব্যাপকভাবে সমর্থন জোগায়।

আফগানিস্তানের পর ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে মার্কিন প্রশাসন।

হামলার পর ওয়াশিংটনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর পেন্টাগন। ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে গত ৩০ আগস্ট দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

২. আকাশপথে ভ্রমণব্যবস্থার রূপান্তর

নাইন-ইলেভেন হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক এটি। আল-কায়েদার ১৯ হামলাকারী ভারী অস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ফ্লাইটে চড়ে বসতে পেরেছিল; এমনকি তারা প্লেনের ককপিটে ঢুকে ফ্লাইটের গতিপথ বদলানোর মতো কাজটিও করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা নাজুক ছিল, তা প্রমাণ হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মেট্রোপলিটন স্টেট ইউনিভার্সিটির এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিজ্ঞানের অধ্যাপক জেফরি প্রাইস বলেন, ‘আগেও বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা বিভাগের কর্মীরা কাজ করতেন। ব্যাজ পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাত্রীদের প্রতি নজর রাখতেন। কিন্তু সেটি আজকের দিনের কড়াকড়ির ধারেকাছেও ছিল না।’

বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ও সংকট কাটাতে ২০০১ সালে কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়ে চালু হয় ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ) নামের একটি স্বাধীন সংস্থা। এক বছরের মাথায় এতে ৫০ হাজার কর্মী নিয়োগ করা হয়।

বিমানবন্দরে আগে যে এক্স-রে মেশিন বসানো ছিল, তা শুধু লৌহজাত দ্রব্য শনাক্ত করতে পারত। এখনকার স্ক্যানারগুলো খুঁটিনাটি সব ধরে ফেলতে সক্ষম। টিএসএর কর্মীরা এখন যাত্রীদের আচরণেও ব্যাপক নজরদারি চালিয়ে থাকেন। এ ছাড়া তাঁদের হাতে রয়েছে পাঁচ শতাধিক আমেরিকানসহ প্রায় ছয় হাজার জনের নো-ফ্লাই তালিকা। শক্ত করে ব্যাগ বাঁধলে বা সদ্য শেভ করা মুখে বিমানে উঠতে গেলে আপনাকে বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।

৩. মুসলিমবিরোধী সংঘাত বেড়েছে

টুইন টাওয়ারে হামলার মাত্র চার দিন পরের ঘটনা। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের মেসা শহরে এক গ্যাসস্টেশনের মালিককে গুলি করে হত্যা করে এক বন্দুকধারী। নিহত বলবীর সিং সোধি ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং শিখ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে তাঁর মাথায় টুপি ছিল। সোধিকে মুসলিম ভেবে হত্যা করে মার্কিন বন্দুকধারী। পরে আরেকটি গ্যাসস্টেশনে গিয়ে সেখানকার লেবানিজ কর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরপর কিছুদূর গিয়ে আফগান-আমেরিকান একটি পরিবারের গাড়ির জানালায় গুলিবর্ষণ করে সে।

ইসলাম শান্তিপূর্ণ ধর্ম, কট্টর সন্ত্রাসবাদীরা একে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে— রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ব্যাপকভাবে এমন বক্তব্য দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বহু মানুষ ৯/১১ হামলার ঘটনার উদাহরণ টেনে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলে থাকেন। তা ছাড়া অবয়বে বা বেশভূষায় মুসলিমদের মতো এমন অনেক পশ্চিমা ব্যক্তিও রোষানলের শিকার হয়েছেন।

২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে মাত্র ১২টি মুসলিমবিরোধী সংঘাতের ঘটনা ঘটে, ২০০১ সালে তা ৯৩-এ গিয়ে ঠেকে। আর ২০১৫ সালে ৯১টি এবং ২০১৬ সালে ১২৭টি এমন ধরনের ঘটনা ঘটে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এ তথ্য দেয়।

পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার শ্যাংকসভিল এলাকায় মাঠে বিমান বিধ্বস্তের পর তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ছবি : সংগৃহীত

৪. বেড়েছে নজরদারি

নাইন-ইলেভেন হামলার মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে পাস হয় ‘দেশপ্রেম আইন’। এফবিআইয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমের সীমারেখা প্রসারিত হয়। এ আইনের বলে জাতীয় নিরাপত্তার নামে এবং মার্কিনিদের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কাউকে ‘তল্লাশি ও মালামাল জব্দ’ করা যায়। আইনটি করতে গিয়ে এত বড় হামলার ঘটনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলো, তার বিস্তারিত খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন আইনপ্রণেতারা।

যেকোনো সময় আবারও ৯/১১ হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, এমন ভয় থেকে গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও এনএসএকে নতুন করে বাড়তি ক্ষমতা দেয় কংগ্রেস। আদালতের নামমাত্র অনুমতিতে তারা যে কারও লাইব্রেরি রেকর্ড ও ইন্টারনেট সার্চ হিস্টোরি দেখতে পারবে। গোয়েন্দারা আগাম নোটিশ ছাড়াই কারও বাড়িঘর তল্লাশি কিংবা উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ফোনে আড়ি পাততে পারবে।

৫. রদবদল হলেও নিরাপদ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

৯/১১ হামলার পর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জিহাদি মতবাদে অনুপ্রাণিত হামলায় ১০৭ জন মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রায় অর্ধেক মৃত্যু ঘটে। টুইন টাওয়ার হামলার পর এমন ভয়াবহ কোনো ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে আর ঘটেনি।