রেকর্ড বন্যায় শঙ্কায় পাকিস্তানের অর্থনীতি

Looks like you've blocked notifications!
জমিতে এতো পানি আটকে আছে যে তা আগামী তিন মাসে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র তানভির কিংরানি ভেবেছিলেন এ বছরের আগস্ট মাসে সে তার টার্ম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে সব কিছু ছেড়ে পরিবারের ১৮ সদস্য নিয়ে সময় পার করতে হচ্ছে অস্থায়ী তাঁবুতে। খবর : আলজাজিরার

কিংরানি হচ্ছেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় সিন্ধু প্রদেশের দাদু শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের হাজি মানিক খান গ্রামের বাসিন্দা; যিনি গত মাস থেকে শুরু হওয়া অতিভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। রেকর্ড এই বন্যায় এই অঞ্চলে এবার প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত  হয়েছেন।

এ ব্যাপারে তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘বন্যায় আমাদের ফসল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের নিজেদের জন্য বা বাজারে বিক্রির জন্য কিছুই নেই। আমাদের প্রায় ১৮ লাখ রুপির ক্ষতি হয়েছে’।

প্রায় ৩০ একর জমির মালিক কিংরানির বাবা, যেখানে তিনি শীত মৌসুমে ধান, তুলা ও গমের চাষ করেন। কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে থাকা ধান ও তুলা কেবল ধ্বংসই হয়নি, এখন গম চাষ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

‘জমিতে এতো পানি আটকে আছে যে তা আগামী তিন মাসে কমার বা নিষ্কাশনের কোনো সম্ভাবনা নেই। এর মানে হচ্ছে গমবীজ লাগানোর জন্য যে সময়টা দরকার তা পার হয়ে যাবে,’ বললেন তানভির কিংরানির বাবা আজিজ কিংরানি।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আজিজ আরও বলেন, ‘পেনশন আর এই জমি ছাড়া আমার অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই। আমার কোনো ধারণাই নেই, অল্প পেনশনের টাকায় ১৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমি কীভাবে চলব। ছেলেকে পড়াশোনা ছেড়ে আমার কাজে সাহায্য করতে বলা ছাড়া আর কোনো উপায়ই হয়তো থাকবে না’।

আগস্ট মাসে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে ৫০০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া পাকিস্তানের দারিদ্র্যপীড়িত বেলুচিস্তান প্রদেশের চিত্রও একইরকম। দেরা আল্লাহ ইয়ার শহরের একজন কৃষক আব্দুল বাশার জাতৈ জানান, তার ২৫ একর জমিসহ পুরো গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। আমি চার-পাঁচটি গ্রামজুড়ে আমার প্রায় দুই হাজার একর জমিতে ধানচাষে ৫ লাখ রুপি বিনিয়োগ করেছিলাম। আশা করছিলাম প্রায় ১৫ লাখ রুপি লাভ হবে, কিন্তু তা হচ্ছে না। এখন আমি শুধু সাহায্যের আশায় খোদার দিকে তাকিয়ে আছি’।

বন্যাকবলিত প্রতিটি পরিবারের গল্পই এরকম। মুষলধারে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক এই বন্যার ধ্বংসলীলায় এ পর্যন্ত ১৩০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বন্যার পানিতে দেশটির ১৬০টি জেলার মধ্যে ৮১টি জেলা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে; যা তিন কোটিরও বেশি মানুষকে করেছে ঘরবাড়িহারা। আশঙ্কা করা হচ্ছে এইসংখ্যা আগামীতে আরও বাড়তে পারে।

তবে জানমালের ক্ষতির বাইরে দেশটির রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষয়ক্ষতি, অসংখ্য বাড়িঘর আর লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি ডুবে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকরা সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান জিডিপির ২২.৭০ শতাংশ। কৃষিখাতে ব্যাপক ধ্বংসলীলা বিশেষ করে রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত তুলা চাষের ওপর এই আঘাত এমন সময়ে এলো যখন দেশটি দ্রুত কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর ২৭.৩০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ধুঁকছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, সিন্ধু প্রদেশের ৮০ শতাংশ ফসল ধ্বংস হয়ে গেছে; যা দেশটির মোট তুলা উৎপাদনের ৩০ শতাংশ যোগান দেয়। দেশটির তুলার ওপর নির্ভর করে সেখানকার ৭০ শতাংশ টেক্সটাইল শিল্পকারখানা, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়সহ সাধারণ মানুষের চাকরির একটি প্রধান উৎস। এসব কারণে এবারের বন্যা দেশকে আরও পিছিয়ে দেবে বলে মনে করেন অল পাকিস্তান টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রহিম নাসির। তিনি বলেন, ‘আমাদের চাহিদা পূরণে চার মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করতে হয়। এবার মনে হচ্ছে এর দ্বিগুণ আমদানি করতে হবে, যার জন্য খরচ হবে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার’।

অন্যদিকে দেশটির অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল ধারণা করছেন, বন্যায় এবার কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে পাকস্তানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এই ক্ষয়ক্ষতি ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। যদিও বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেতু, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসল আর গবাদি পশুর সংখ্যা হয়তো নির্ধারণ করা যাবে, তবে সরকারকে সমগ্র অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ শাহরুখ ওয়ানি বলেন, ‘এখন সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হলো মারাত্মক অর্থ সংকটে থাকা অবস্থায় গত মাসে আইএমএফর অনুমোদনের পর বেল আউট প্যাকেজের আওতায় সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি অনুসারে কর বাড়ানো এবং কৃচ্ছ্রতা সাধনে নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারা’।

ওয়ানি আরও বলেন, ‘সরকারের জন্য বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, কেননা ধ্বংস হওয়া ফসলের ক্ষতি মেটাতে সরকারকে আরও খাদ্য আমদানি করতে হবে। অন্যদিকে তুলা স্বল্পতায় দেশের টেক্সটাইল শিল্প পড়বে চরম সঙ্কটে’।

তার মতে এই অর্থ বছরে দুই ধরনের কঠিন বিষয়ের মুখে পড়বে। এক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ায় রাজস্ব আয় খাতে রাজস্ব সঙ্কট দেখা দেবে, দুই, ব্যয়ের খাতে মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন কাজে খরচ বাড়বে।