গান্ধীকে আদর্শ মানতেন বিন লাদেন!
আজীবন শান্তির সপক্ষে থাকা মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও আদর্শ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতেন আল-কায়েদার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেন! লাদেনের বক্তব্যের কয়েকটি অডিও টেপ বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই জানিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ ফগ মিলার। সম্প্রতি লাদেনের বক্তব্য সংবলিত প্রায় এক হাজার ৫০০ অডিও টেপ বিশ্লেষণ করে লেখা ফগ মিলারের বই ‘দুঃসাহসী তপস্বীতে’ এমন তথ্যই জানিয়েছেন তিনি।
রোববার বইটি নিয়ে বিবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফগ মিলার মন্তব্য করেন, মানবচরিত্রের বৈপরীত্য বোধহয় একেই বলে। ১৯৯৩ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় ওসামা বিন লাদেন বলেন, ‘শান্তির দূত মহাত্মা গান্ধী তাঁর সমর্থকদের মার্কিন পণ্য বর্জন করতে বলেছিলেন। সেই বক্তব্য এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম থেকে আমি অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই।’
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিলার জানিয়েছেন, আরবি ক্যাসেট থেকে লাদেনের বক্তব্যের এই অংশটুকু আবিষ্কার করে তিনি প্রথমে খুবই অবাক হন। পরে অন্যান্য বক্তব্য এবং ডায়রিতে লেখা মন্তব্য থেকেও জানা যায়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর কথা লাদেন ভালোভাবেই জানতেন এবং তাঁকে কিছু ক্ষেত্রে আদর্শ বলে মানতেন। ১৯৯৩ সালের বক্তব্যের শেষে তাই গান্ধীকে একজন অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি গান্ধীর বিদেশি পণ্য বর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। অনুসারীদেরও তিনি বিদেশি পণ্য বর্জনের জন্য অনুরোধ করেন। বিন লাদেন সে বক্তৃতায় বলেন, ‘গ্রেট ব্রিটেনের (যুক্তরাজ্য) বিষয়টি চিন্তা করলে দেখা যায়, এমন একটি রাজত্ব তাদের ছিল, যেখানে সূর্য অস্ত যেত না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিটেন তাদের বৃহত্তম কলোনিগুলো পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর কারণ ছিল গান্ধী তাদের পণ্য বর্জন করেন। একই কাজ আমাদের করতে হবে আমেরিকার জন্য।’ মিলার আরো জানান, লাদেনের অডিও বক্তব্যে মার্কিন পণ্য বর্জনের বিষয়টি থাকলেও সেখানে আক্রমণের কথা নেই।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি সুরক্ষিত বাড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী নেভি সিলের সেনাদের হাতে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। এর আগে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান শুরুর পর, লাদেন কান্দাহারে অবস্থিত নিজের ঘাঁটি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। ১৯৯৭ সালে জেহাদের জন্য সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ত্যাগের পর কান্দাহারেই আল-কায়েদার ঘাঁটি বানিয়েছিলেন তিনি।
মিলার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান আক্রমণ শুরু হওয়ার পর তালেবানের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নেতা ওই শহর ত্যাগ করেন। এদেরই একজন ছিলেন তৎকালীন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াকিল আহমেদ মুত্তাওয়াকিল। কান্দাহারে তালেবান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্টোদিকে কয়েকটি বাড়িতে আল-কায়েদার শীর্ষপর্যায়ের নেতারা প্রায়ই বৈঠকে মিলিত হতেন। নেতারা চলে যাওয়ার পর এখানকারই একটি শূন্য বাড়িতে পাওয়া যায় ওসামা বিন লাদেনের দেড় হাজার ক্যাসেট।
পরে ২০০৪ সালের শুরুর দিকে ওই পরিত্যক্ত বাড়িতে বাস করতে এসে আফগান একটি পরিবার ওই ক্যাসেটগুলো খুঁজে পায়। আর তাঁদের হাতেই মুলত আবিষ্কৃত হয় ওসামা বিল লাদেনের কন্ঠস্বরে প্রায় দেড় হাজার ক্যাসেটে ও বহু বিচিত্র রেকর্ড। পরবর্তী সময়ে এগুলো এক ক্যাসেটের দোকানি কিনে নেন। কিন্তু এগুলো নষ্ট হওয়ার আগেই সিএনএনের এক ক্যামেরাম্যানের নজরে পড়ে। এরপর তিনি দোকান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে নেন। ক্যাসেটগুলো পরবর্তী সময়ে নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গন্তব্যে।
সর্বশেষ ক্যাসেটগুলো এসে পড়ে ম্যাসাচ্যুসেটের উইলিয়াম কলেজের আফগান মিডিয়া প্রজেক্টের প্রধান নির্বাহী ডেভিসের কাছে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষার বিশেষজ্ঞ ফগ মিলারকে দিয়ে ক্যাসেটগুলো থেকে আরবি কথা উদ্ধার করেন। তখনই জানা যায়, এ ক্যাসেটগুলোতে রেকর্ড করা আছে ওসামা বিন লাদেনের বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য বক্তব্য।
পরবর্তী সময়ে লাদেনের বক্তব্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে ‘দুঃসাহসী তপস্বী’ বইটিতে ফগ মিলার জানান, ক্যাসেটের রেকর্ডিং শুরু হয়েছে ১৯৬০-এর দশক থেকে। সে সময়েই বিভিন্ন স্থানে ওসামা বিন লাদেনের দেওয়া বক্তৃতা রেকর্ড করা শুরু হয়। তিনি ছাড়াও এতে পাওয়া যায় দুই শতাধিক বিভিন্ন বক্তার রেকর্ডকৃত বক্তব্য। তবে এসব টেপে লাদেনের বক্তব্যে কঠোর পশ্চিমা বিরোধিতা পাওয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা মার্কিনিদের বিরুদ্ধে হামলারও কোনো নির্দেশনা নেই। এগুলোতে রেকর্ডকৃত তথ্যে পাওয়া যায়, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলা শুরুর পর বিন লাদেনের সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করার গল্প।
আরব সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ মিলার ক্যাসেটে থাকা লাদেনের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে লাদেনের পথপরিক্রমার ধারণাগুলো নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সেখানে মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী কথাবার্তা তেমন পাননি বলেই জানান।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিলার বলেন, বহু বছর ধরেই লাদেন ‘অবিশ্বাসী’দের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেছেন। এসব বক্তব্যে তাঁর দৃষ্টিতে মুসলমানদের বড় শত্রু ছিল মুসলমানরাই। মিলার জানান, লাদেনের বক্তব্যে শত্রু হিসেবে পাওয়া যায় শিয়া, ইরাকি বাথ, কমিউনিস্ট ও মিসরীয়দের। এসব ক্যাসেটের মধ্যে রয়েছে ইসলামের ধর্মীয় বাণী, ধর্মীয় গান এবং মুজাহিদদের উদ্দীপ্ত করার জন্য গাওয়া গান। এ ছাড়া লাদেনের ক্যাসেট সংগ্রহে পাওয়া গেছে বেশ কিছু ফরাসি লোকসঙ্গীত।