বিশ্ব কি পরবর্তী অতিমারির জন্য প্রস্তুত?
প্রাণঘাতী কোভিড অতিমারির তাণ্ডব শুরু হওয়ার পাঁচ বছর পরেও মানুষকে বেকায়দায় ফেলে দেওয়ার মতো একটি প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। আর সেটি হলো–বিশ্ব কি পরবর্তী অতিমারি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত?
অতিমারি প্রতিরোধের প্রাণকেন্দ্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই গ্রহের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কোন জায়গা থেকে হুমকিটি আসতে পারে, তা নির্ধারণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থাটি বলছে, অতিমারি মোকাবিলায় বিশ্ব কোভিড আঘাত হানার সময়ের চাইতে অনেক বেশি প্রস্তুত। তবে এর পাশাপাশি তারা এটাও বলছে, প্রস্তুতি প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিতে
পরবর্তী অতিমারির জন্য বিশ্ব আগের চাইতে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ডব্লিউএইচও প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘হ্যাঁ এবং না।’ তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘পরবর্তী অতিমারি যদি আজই চলে আসে, তবে এই বিশ্ব এখনও আগের মতোই দুর্বলতার মুখোমুখি হবে।’
গেব্রেয়াসুস আরও বলেন, ‘তবে বিশ্ব অনেক কষ্টকর শিক্ষা পেয়েছে, যা অতিমারি আমাদের শিখিয়েছে এবং এটা থেকে রক্ষা পেতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করেছে।’
ডব্লিউএইচও’র মহামারি ও অতিমারি প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ বিষয়ক পরিচালক মারিয়া ভ্যান খেরখোভ বলেছেন, ‘এটা একটা বিষয় যে আমরা আরেকটি অতিমারি মোকাবিলা করতে যাচ্ছি, তবে যেন তা না হয়।’
মারিয়া ভ্যান খেরখোভ আরও বলেন, ‘২০০৯ সালের (এইচ১এন১) ফ্লু অতিমারি ও কোভিডের কারণে পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে। তবে আমি মনে করি, বিশ্ব আরেকটি ব্যাপক ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব বা অতিমারির জন্য প্রস্তুত নয়।’
বিশেষজ্ঞদের মত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গঠন করা অতিমারি প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ বিষয়ক স্বাধীন প্যানেল তাদের মূল্যায়নে সুনির্দষ্টভাবে কোনো কিছু বলতে পারেনি। তহবিল ও অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপকরণ ভ্যাকসিনের সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে তারা বলেছে, ‘২০২৫ সালে আরেকটি অতিমারির হুমকি মোকাবিলায় বিশ্ব প্রস্তুত নয়।’
এ বিষয়ে স্বনামধন্য ডাচ ভাইরোলজিস্ট মারিওন কুপমান্স বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, “পরবর্তী অতিমারির জন্য এম-আরএনএ ভ্যাকসিনের সফলতা ও দ্রুত উৎপাদন ‘গেম চেঞ্জারের’ ভূমিকা রাখতে পারে।” তবে তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, “ভ্যাকসিন গ্রহণে ইতস্তত করা এবং সেগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্যের ‘বিস্ময়কর’ মাত্রা আমাদের সামনে এটাই তুলে ধরে যে, এসব প্রতিবন্ধকতা ভ্যাকসিন ব্যবহারের বড় অন্তরায়।”
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এসএএস ইনস্টিটিউটের একজন মহামারিবিদ ম্যাগ শেফার বলেন, ‘শনাক্ত করা ও দ্রুত তথ্য বিনিময় করার জন্য জনস্বাস্থ্য এজেন্সিগুলোর আরও চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।’
ম্যাগ শেফার বলেন, ‘না, আমি মনে করি না কোভিড মোকাবিরায় যে প্রস্তুতি ছিল, এখন তার চাইতে আমরা বেশি প্রস্তুত।’ যদিও তিনি মনে করেন, এখন সমাজে একে অন্যকে রক্ষায় আস্থা বেড়েছে। আর এসব কাজে দূরত্ব বজায় রাখা, ফেসমাস্ক ব্যবহার, ভ্রমণ সীমিত করার মতো বিষয়গুলো খুব সাহায্য করছে।
উপশমের তৎপরতা
পরবর্তী অতিমারি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বার্লিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অতিমারি ও মহামারি সংক্রান্ত হাব হুমকি শনাক্তের জন্য এবং সেগুলো উপশমের জন্য সম্মিলিতভাবে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ৭৫টি দেশে ৫০টি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২২ সাল থেকে ৮৮৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল বিতরণ করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থানীয় ভ্যাকসিন উৎপাদন উন্নত করতে একটি এম-আরএনএ প্রযুক্তি ট্রান্সফার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া অতিমারি প্রতিরোধ কাজের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় বায়ো ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য একটি গ্লোবাল ট্রেইনিং হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
নতুন বৈশ্বিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা
কোভিড আঘাত হানার পর ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এটি হলো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধি অনুসারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা। তবে সে বছরের ১১ মার্চের আগে অর্থাৎ ডব্লিউএইচও’র প্রধান কোভিড-১৯কে অতিমারি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দেশ এতে নড়েচড়ে ওঠেনি।
প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গত জুনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা হিসেবে ‘অতিমারি জরুরি অবস্থা’ জারির বিধি প্রণয়ন করা হয় এবং দেশগুলোকে আরও দ্রুত সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।
অতিমারি চুক্তি
কোভিডের মতো ক্ষয়ক্ষতি যাতে আবারও না ঘটে তা এড়াতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অতিমারি প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিকারের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দর-কষাকষির পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৪টি দেশ চুক্তির ধারাগুলো কী হবে, সে বিষয়ে বৃহৎ ঐক্যমতে পৌঁছে। তবে এতে কিছু কিছু বিষয়ে মতদ্বৈততাও ছিল।
এ সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলো ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের বিরুদ্ধে গরিব দেশগুলোকে ‘সাইডলাইনে’ রাখার মতো অভিযোগও ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের মে মাসের মধ্যে চুক্তিতে পৌঁছানোর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
পরবর্তী হুমকির খোঁজে
অতিমারির পরবর্তী হুমকি কোথা থেকে আসে সেটি নির্ধারণ করতে বিশেষজ্ঞরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ভাইরোলজিস্ট টম পিকক এএফপিকে বলেন, সম্ভাব্য এইচ৫এন১ বার্ড ফ্লু অতিমারিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
এ সম্পর্কে বিশ্বের ২০০ বিজ্ঞানীকে ১৬৫২টি প্যাথোজেন (রোগের বাহক) নিয়ে গবেষণা চালালানের কাজ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসব প্যাথোজেনের অধিকাংশই ভাইরাস। তারা ৩০টির বেশি প্যাথোজেন শনাক্ত করতে পেরেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯, ইবোলা, মারবার্গ, লাসা জ্বর, এমইআরএস, এসএআরএস ও জিকা মতো রোগের প্যাথোজেন শনাক্ত করার কাজ। এ ছাড়া তালিকায় আছে ‘এক্স ডিজিজ’ নামক অজানা রোগের প্যাথোজেনও।
নতুন সৃষ্টি হওয়া রোগের হুমকি মোকাবিলায় আরও জ্ঞান লাভ, উপকরণ ও প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য পরিকল্পনা চলছে।