দুর্ঘটনা নয়, খাসোগি হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত : এরদোয়ান
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে নিখোঁজ হওয়া সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি দুর্ঘটনাবশত নিহত হয়েছেন, সৌদি কর্তৃপক্ষের এমন দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত এবং সেপ্টেম্বরে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়।’
এরদোয়ান বলেন, ‘তুরস্কের হাতে শক্ত প্রমাণ রয়েছে যে, খাসোগিকে ২ অক্টোবরই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খুন করা হয়।
আজ মঙ্গলবার আঙ্কারায় তুর্কি পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে এরদোয়ান এই দাবি করেন। এর আগে তিনি ঘোষণা দেন, মঙ্গলবার খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘নগ্নসত্য’ প্রকাশ করবেন তিনি।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজনদের বিচার ইস্তাম্বুলেই করতে চান বলে জানান এরদোয়ান। তিনি এ সময় সৌদি আরবের কাছে জানতে চান, খাসোগির মরদেহ কোথায় এবং কে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা?
১৮ জনকে সৌদি আরবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন এরদোয়ান। তবে তিনি আজকের বক্তব্যে হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি।
এমনকি গণমাধ্যমের খবরে বলা অডিও বা ভিডিও সম্পর্কেও কিছু বলেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, ১৫ জনের সৌদি দল তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে হত্যাকাণ্ডের আগে এবং ঘটনার দিন ইস্তাম্বুলে আসে। হত্যাকাণ্ডে ওই ১৫ জনকে কনস্যুলেটের ভেতরে থাকা তিনজন সহযোগিতা করেন বলেও জানান এরদোয়ান।
এরদোয়ান বলেন, ‘প্রশ্ন থেকে যায়, কেন ১৫ জনের দলটি সৌদি আরব থেকে কার নির্দেশে তুরস্কে এসেছিল? জামাল খাসোগিকে হত্যার পর মরদেহ কোথায় রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্থানীয় একজনের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে, তাহলে সেই স্থানীয় ব্যক্তি কে?’ তিনি আরো বলেন, ‘এসব প্রশ্নের জবাব সৌদি আরবকে দিতে হবে।’
পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে এরদোয়ান বলেন, ‘আমরা পরের দিনই জানতে পারি যে খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে। শুরুর দিকে তদন্ত ব্যহত হয় কারণ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গোয়েন্দারা কনস্যুলেটে ভেতরে যেতে পারেনি।’
এরদোয়ান সৌদি বাদশাহর সঙ্গে আলাপকালে ইস্তাম্বুলের কনসাল জেনারেল এই পরিস্থিতি মোকাবিলার যোগ্য নয় বলে জানালে পরের দিনই ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানান এরদোয়ান। হত্যাকাণ্ড চলাকালে ওই কনস্যুলেটে দায়িত্বে থাকা কনসাল জেনারেল বরখাস্ত হয়ে পরের দিনই সৌদি আরব চলে যান।
সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানান এরদোয়ান।
৬ অক্টোবর প্রথম রয়টার্সের এক প্রতিবেদককে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। দেখানো হয় ভেতরে খাসোগি নেই।
খাসোগির আত্মার শান্তি কামনা করে এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে খাসোগি ইস্যুতে কথা বলা শুরু করেন এরদোয়ান।
গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর আর খোঁজ মেলেনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কয়েকদিন আগে জানান, তিনি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যায় ‘নগ্নসত্য’ প্রকাশ করতে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য খাসোগি হত্যায় সৌদি সরকারের দেওয়া ব্যাখ্যাকে অসম্পূর্ণ বলেন। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাখ্যায় মিথ্যার উপাদান রয়েছে।’ এ সময় ট্রাম্প অবশ্য সৌদি যুবরাজকে ‘শক্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ বলে উল্লেখ করেন।
ট্রাম্প বরাবরের মতো এ যাত্রায়ও সৌদি রাজপরিবারে পাশে দাঁড়িয়েছেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রশংসা করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যকার সুসম্পর্কের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরেন।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স এ হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার তথ্য প্রকাশ করতে সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিয়ে-সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে যান খাসোগি। বাগদত্তা তুর্কি নারী হেতিজ জেঙ্গিসকে বাইরে রেখে কনস্যুলেটে প্রবেশের পর আর ফেরেননি খাসোগি।
এ নিয়ে তুরস্ক ও সৌদি সরকার একে অপরকে দোষারোপ করে আসছিল। সৌদি আরব বলে আসছিল, কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছেন খাসোগি।
অন্যদিকে তুরস্ক শুরু থেকে দাবি করে আসছে, সৌদি আরব থেকে ১৫ সদস্যের একটি দল খাসোগি হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে তুরস্কে আসে। সেই দলে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও ছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ এক উচ্চপদস্থ সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
সৌদি আরব অবশ্য দুই সপ্তাহ পর গত ১৯ অক্টোবর শুক্রবার স্বীকার করে নেয় যে খাসোগি সৌদি কনস্যুলেটে খুন হয়েছেন।
সৌদি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির বরাতে জানানো হয়, কনস্যুলেটে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে খাসোগি এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয়, এতে খাসোগি নিহত হন।
এর আগে সিএনএন অবশ্য তুরস্কের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাতে জানায়, খাসোগিকে হত্যা করার পর তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করা হয়।
সে সময় তুরস্কের একটি দৈনিক পত্রিকা জানায়, খাসোগিকে হত্যার পর ইস্তাম্বুল বা আশপাশের কোনো বনে বা খামারে তাঁর লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে।
পরে ২২ অক্টোবর রোববার সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর জানান, জামাল খাসোগিকে ভুলে হত্যা করা হয়েছে।
সৌদি আরব এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সৌদ আল-কাহতানিসহ পাঁচজনকে বরখাস্ত করে এবং ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে।