যেভাবে তৈরি হলো ‘পানামা পেপারস কাহিনী’
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/04/05/photo-1459857379.jpg)
রোববার দৈনন্দিন খবরাখবরের পাল্লায় ভর করা পুরো দুনিয়ার গণমাধ্যম হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল যেন এক প্রচণ্ড ঝাঁকিতে। ধাক্কার নাম— দ্য পানামা পেপারস। দুনিয়াজোড়া রথী-মহারথীরা কীভাবে নামে-বেনামে কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদ জমিয়েছেন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, তার সব দলিল-দস্তাবেজ বেরিয়ে পড়েছে থলের বেড়ালের মতো। খবর এখন একটাই, পানামা পেপারস। কীভাবে প্রকাশ হলো এই বিশাল তথ্যাদির খবর? নিম্যান জার্নালিজম ল্যাবের বিস্তারিত বিবরণে পাওয়া গেল পুরো ঘটনার সবিশেষ।
পানামা পেপারসের তথ্য থেকে পাওয়া গেছে অর্থ তছরুপ, অস্ত্র চোরাচালান, কর ফাঁকি এবং অর্থ নিয়ে ধোঁকাবাজির পাহাড়সম তথ্য। পৃথিবীর প্রভাবশালী শতাধিক রাজনীতিবিদ রয়েছেন এই তালিকায়, এ ছাড়া রয়েছেন বিত্তশালী থেকে শুরু করে মিডিয়া সেলিব্রিটি, খেলার মাঠের তারকা। এই তথ্য যেমন চমকপ্রদ, এই তথ্যকে সংবাদে রূপদানের প্রক্রিয়াটিও নেহাত কম রোমাঞ্চকর নয়। এই গোপন প্রোজেক্টটিতে প্রায় দুই বছর ধরে কাজ করেছেন শত শত পোড় খাওয়া সাংবাদিক; যার সবকিছুই হয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
আইসিআইজের ফাঁস করে দেওয়া পানামা পেপারসের তথ্যের পরিমাণ অকল্পনীয়। প্রায় ৪০ বছরের হিসাব খতিয়ান কেবল ডকুমেন্ট ফাইলের ওজনেই পাক্কা দুই দশমিক ছয় টেরাবাইট! এই বিশাল তথ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিবেদকদের জন্য ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। পানামা পেপারসের তথ্য ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যের অনুপাতে (এক দশমিক ৭৩ গিগাবাইট) হাজারগুণে বেশি। সামগ্রিকভাবে, পানামা পেপারে এক কোটি ১৫ লাখ ফাইল রয়েছে—যার মধ্যে ৪৮ লাখ ই-মেইল, ১০ লাখ ছবি এবং ২১ লাখ পিডিএফ ফাইল।
এই তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়েছে খুবই উন্নতমানের প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। ওয়্যারড রিপোর্টসের তথ্যমতে, এক ‘অজানা’ সূত্র ‘স্যুডয়েশ যেইটং’ নামের এক জার্মান পত্রিকার প্রতিবেদকের সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আলাপ করে পুরো বিষয়ের আভাস দেন। এরপর এই ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্য নিয়ে কাজ করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ডেভেলপাররা একটি বিশেষ সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন। দুনিয়াজোড়া বিভিন্ন পার্টনার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এই সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে তথ্যের আদান-প্রদান করেন। রিয়েল-টাইম চ্যাট সিস্টেমে সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে আলাপ, ডকুমেন্টে উল্লেখিত নামের সঙ্গে অন্যান্য তথ্য মেলানো, আর আনকোরা তথ্যকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরের ব্যবস্থাও করা হয়। ‘নুইক্স’ নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি প্রাপ্ত বিশাল নথি প্রাথমিকভাবে সাজানোর দায়িত্ব পালন করে।
পুরো বিষয়টিই ছিল একটি সম্মিলিত, দলীয় উদ্যোগ। প্রাথমিকভাবে জার্মান পত্রিকা ‘স্যুডয়েশ যেইটং’ ফাঁস হয়ে যাওয়া ডকুমেন্ট হাতে পায়। তবে পত্রিকাটি এই তথ্য একলা যাচাই করতে যায়নি।
আইসিআইজের সঙ্গে কাজ করেছে তারা। একই সঙ্গে ফ্রান্সের ‘লো ম্যঁদ’, আর্জেন্টিনার ‘লা নাসিওন’, সুইজারল্যান্ডের ‘সোনটাগজযেইটং’ এবং যুক্তরাজ্যের ‘গার্ডিয়ান’ ও ‘বিবিসি’ এই প্রকল্প নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করেছে; যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন প্রায় ৪০০ সাংবাদিক।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংবাদ সংস্থাও কিছু অংশে এই প্রকল্পে কাজ করেছে। পানামা পেপারস যাচাই করেছে দুনিয়াজোড়া শতাধিক সংবাদ সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রেও এমন কাজের ছিটেফোঁটাও যাবে না, তা কি আর হয়? ম্যাকক্লাচিস শার্লট অবজার্ভার, মায়ামি হেরাল্ড এবং ইউনিভিশন এই প্রকল্পের কিছু অংশে কাজ করেছে। মজার বিষয় হলো—নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় স্থান পায়নি পানামা পেপারসের খবর!
আইসিআইজে আপাতত পূর্ণাঙ্গ নথি প্রকাশ করবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উইকিলিকস যেমন তাদের পাওয়া সব তথ্য ওয়েবজগতে ফাঁস করে দিয়েছিল, যাতে তা সবাই দেখতে পায়, আইসিআইজে তেমনটি করতে যাচ্ছে না। আইসিআইজের পরিচালক জেরার্ড রাইল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা উইকিলিকস নই। আমরা এটাই দেখাতে চাইছি যে সাংবাদিকতা দায়িত্ব নিয়ে করা যায়।’