সাংবাদিক শফিক রেহমানের মুক্তি দাবি
প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ) এবং দ্য ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ওএমসিটি)।
গতকাল মঙ্গলবার এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশে বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। প্রকাশিত লেখার জন্য দেশের বহু জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে। সম্প্রতি এর শিকার হয়েছেন ৮১ বছর বয়সী সম্পাদক, মৃত্যুদণ্ডের সাজার বিরোধিতাকারী, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং সাংবাদিক শফিক রেহমান। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করতে দেশের বিচারিক ব্যবস্থার সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার তিনি।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘গত ১৬ এপ্রিল সকালে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই শফিক রেহমানকে আটক করে নিয়ে যায়। এই সাংবাদিকের বাড়িতে প্রবেশের জন্য একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। এর পর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান তাঁরা।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘শফিক রেহমানকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে ২০১৫ সালে দায়ের হওয়া একটি অপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছিল। জয় যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। ঢাকার একজন মুখ্য মহানগর হাকিম পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শফিক রেহমানের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে তাঁকে নির্যাতন করা হতে পারে বলে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ‘সাংবাদিক ও সমালোচকদের মধ্যে সরকারি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি হলেন শফিক রেহমান। এ ছাড়া বিখ্যাত সাংবাদিকসহ আরো বহু ব্যক্তি নানা ফৌজদারি মামলার আসামি হয়ে এই মুহূর্তে আটক আছেন।’
এতে আরো বলা হয়, ‘২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি দুর্নীতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রতিবেদন এবং প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করার অপরাধে পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিন বছর ধরে কারাভোগ করছেন মাহমুদুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ৭২টি ফৌজদারি মামলা। গত এক বছর ধরে বারবারই আদালতের মাধ্যমে জামিন নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই পুলিশ নতুন নতুন মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জামিনে মুক্তি পেতে দিচ্ছে না।’
বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো আরো জানায়, ‘২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি পর্নোগ্রাফি আইনে গ্রেপ্তার করা হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে। বিএনপির নির্বাসিত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বক্তব্য প্রচারের পরপরই মূলত তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় সরকারপন্থী বিতর্কিত এক ব্যবসায়ী আবদুস সালামের কাছ থেকে কিনে নেন একুশে টেলিভিশনের বেশির ভাগ শেয়ার। আবদুস সালাম এখনো কারাভোগ করছেন।’
‘সাপ্তাহিক ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার সম্পাদক শওকত মাহমুদকে গত বছরের ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। এ মুহূর্তে তাঁর বিরুদ্ধে ২৪টি ফৌজদারি মামলা দেখানো হয়েছে। সরকারবিরোধী পক্ষের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল এবং তিনি সরকারের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাহমুদুর রহমানের মতো শওকত মাহমুদকে যখনই আদালত জামিন দিচ্ছেন, তখনই নতুন কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
‘ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ৭৯টি মামলা রয়েছে। ২০০৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে। অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল এবং এসব প্রকাশ করা তাঁর ভুল ছিল বলে স্বীকার করেন মাহফুজ আনাম। কিন্তু এর পরও ১৭টি রাষ্ট্রদ্রোহ ও ৬২টি মানহানির মামলা দায়ের করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ১১ এপ্রিল হাইকোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৭২টি মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। তবে এসব অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে অন্তত ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে মাহফুজ আনামের।’
বিবৃতির সবশেষে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে রাখতে সরকারের এই প্রবণতা বাংলাদেশে একটি ভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিবেশ তৈরি করেছে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদের জোর করে কারাবন্দি করে রাখার কারণে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সই করা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনিয়েন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসেরও লঙ্ঘন করছে। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এমন হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নিজের মত প্রকাশের অধিকার প্রদর্শন করার অপরাধে শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, আবদুস সালাম, শওকত মাহমুদসহ গ্রেপ্তার সব বন্দিকে অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া উচিত।’