দুধের শিশুকে চায়ে ভোলানোর চেষ্টা মায়ের, ওষুধে ঘুমিয়ে রাখেন দীর্ঘক্ষণ

Looks like you've blocked notifications!
ডব্লিউএফপির তোলা আফগানিস্তানের পুরোনো ছবি

ক্ষুধায় কাতর শিশুদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন না মা। এদিকে, নেই আয়। পাচ্ছেন না সহযোগিতাও। ফলে, দুধের শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে বোতলে দিচ্ছেন চা। আবার ওষুধের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় রাখছেন ঘুম পাড়িয়ে। এমন ঘটনা আফগানিস্তানের। দেশটির রাজধানী কাবুলের পূর্বাঞ্চলে সোহাইলা নিয়াজির বাস। নিজের মাটির ঘরের মেঝেতে বসে এমন সব তথ্য দেন এই মা।

সোহাইলা নিয়াজি বলেন, ‘সবশেষ আমি সন্তানের জন্য দুধ কিনতে পেরেছিলাম দুই মাস আগে। সাধারণত আমি সন্তানকে খাওয়াতে দুধের বোতলে চা রেখে দেয়। অথবা, চায়ের মধ্যে রুটি ভিজিয়ে তাকে খাওয়াই।’

সোহাইলা একজন বিধবা। তার বাড়িতে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কাঁদা মাটি দিয়ে হেঁটে তার বাড়িতে যেতে হয়। সোহাইলার ছয় সন্তান রয়েছে, যাদের মধ্যে সবার ছোটজনের বয়স ১৫ মাস। তার নাম হুসনা ফাক্কেরি। ১৫ মাসের মেয়েকে সোহাইলা যে চা দেন সেটি আফগানিস্তানের ঐতিহ্য। সবুজ পাতা ও গরম পানি দিয়ে এই চা তৈরি করা হয়। ব্যবহৃত হয় না কোনো দুধ ও চিনি। এই চায়ে কোনো পুষ্টিগুণ নেই।

সোহাইলা সেই এক কোটি মানুষের মধ্যে একজন, যারা কি না জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আওতায় জরুরি খাদ্য সহায়তা পেত। কিন্তু, তহবিল ঘাটতির জন্য সহায়তায় কাঁটছাঁট করা হয়েছে। আর এতেই আফগানিস্তানের নারীদের দ্বারা পরিচালিত পরিবারগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছে। হিসেব অনুযায়ী, এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।

তালেবান শাসেনের জন্য বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারছে না সোহাইলা। এতে করে পরিবারের সদস্যদের খাওয়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। এই মা বলেন, ‘এমন অনেক রাত গেছে যখন আমাদের খাওয়ার কিছু ছিল না। আমি আমার বাচ্চাদের বলি, এই রাতে আমি ভিক্ষা করতে কোথায় যেতে পারি? তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমায় এবং যখন তারা জেগে ওঠে, তখন আমি ভাবি—আমার কী করা উচিত। যদি কোনো প্রতিবেশী খাবার নিয়ে আসে, সন্তানেরা আমাকে দাও আমাকে দাও বলে হইচই করে। আমি তখন তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার চেষ্টা করি।’

ক্ষুধার্ত মেয়েকে শান্ত করতে ঘুমের ওষুধ দেন বলে জানান এই নারী। সোহাইলা বলেন, ‘আমি ওষুধ দেয় যাতে সে ঘুম থেকে উঠে দুধ না চায়। কারণ, আমার কাছে তাকে দেওয়ার মতো দুধ নেই। তাকে ওষুধ দেওয়ার পর সে এক সকাল থেকে পরের দিন পর্যন্ত ঘুমায়। মাঝে মাঝে সে বেঁচে আছে কি না, আমি পরীক্ষা করে দেখি।’

ওই বাচ্চাকে সোহাইলা কী ওষুধ দেন, সেটি পরীক্ষা করে বিবিসি জানতে পারে, ওষুধটি অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যান্টি অ্যালার্জির। চিকিৎসকরা বিবিসিকে বলেন, ওষুধটি তেমন ক্ষতিকারক না। তবে, অনেক আফগান অভিভাবক ক্ষুধার্ত সন্তানদের কিছু ওষুধ দেয় যেগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

সোহাইলা জানান, তার স্বামী ছিল একজন বেসামরিক। ২০২২ সালে পাঞ্জশির প্রদেশে তালেবান ও বিরোধীদের গোলাগুলিতে তিনি প্রাণ হারান। স্বামীর মৃত্যুর পর ডব্লিউএফপিই ভরসা ছিল এই নারীর। তবে, বর্তমানে ডব্লিউএফপি বলছে, তারা মাত্র ৩০ লাখ লোককে সহায়তা দিতে সক্ষম, যা সহায়তা পাওয়ার যোগ্যদের থেকেও এই পরিমাণ এক চতুর্থাংশেরও কম।

বর্তামনে সোহাইলা সম্পূর্ণরূপে আত্মীয় বা প্রতিবেশিদের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। বিবিসির প্রতিবেদকরা যতক্ষণ সোহাইলার বাড়িতে অবস্থান করেছিল এর বেশিরভাগ সময় ১৫ মাস বয়সী হুসনা শান্ত বা নিস্ক্রিয় ছিল।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, আফগানিস্তানের ৩০ লাখেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, যার মধ্যে হুসনা একজন। আর ৩০ লাখের মধ্যে এক চতুর্থাংশেরও বেশি শিশু  গুরুতর তীব্র অপুষ্টি ভুগছে। জাতিসংঘ বলছে, আফগানিস্তানে এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ ঘটনা।

২০২১ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবানরা। এরপরে স্টপগ্যাপ ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) স্বাস্থ্যকর্মীদের স্যালারি দিচ্ছিল। একসঙ্গে ৩০টিরও বেশি হাসপাতালে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছিল। তবে, স্টপগ্যাপ ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় রেডক্রসের সহায়তা বন্ধের উপক্রম।

বর্তমানে কাবুলের ইন্ধিরা গান্ধী শিশু হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. মোহাম্মদ ইকবাল সাদিক। তালেবান সরকার কর্তৃক নিয়োজিত এই চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন সরকার থেকেই আসছে। তবে, সবার বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। আগের তুলনায় অর্ধেক বেতন পাচ্ছে সবাই।’ হাসপাতালটি নিজেদের বহির্বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানের অপুষ্টি ওয়ার্ডটি রোগীতে পূর্ণ। এক বেডে একের অধিক শিশুকে রাখা হচ্ছে।’

হাসপাতালটির একটি বেডের এক কোণে রয়েছে ১৪ মাসের শিশু সুমাইয়া। নবজাতকের ওজনের সমান বয়স তার। এই শিশু মুখ কুঁচকানো যেমন অনেকটা বয়স্ক ব্যক্তির মতো।

সুমাইয়ার পাশেই রয়েছে মোহাম্মদ শাফি। ১৮ মাস বয়সী এই শিশুর ওজন তার বয়সের তুলনায় অর্ধেক। শাফির বাবা একজন তালেবান যোদ্ধা। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। রোগে মারা গেছে এই শিশুর মাও।

যখন বিবিসির প্রতিবেদকরা শাফির বেড অতিক্রম করছিল তখন ওই শিশুর দাদি হায়াত বিবি তার গল্প বলার কথা জানান। এই বৃদ্ধা বলেন, তার নাতিকে হাসপাতালে আনতে তালেবানরা সাহায্য করেছে। কিন্তু, এই বৃদ্ধা জানে না কীভাবে তারা এখান থেকে পার পাবে। হায়াত বিবি বলেন, ‘আমি সৃষ্টিকর্তার ভরসায় আছি। আমার আর কোথাও ফিরে যাওয়ার মতো নেই। আমি একেবারেই হারিয়ে গেছি।’

আফগানিস্তানের এমতাবস্থার বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদক কথা বলে তালেবান সরকারের প্রধান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহির সঙ্গে।  এ অবস্থায় আরও বেশি তহবিল পেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাজি করাতে তারা কী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাতা দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো না হওয়ায় সাহায্য বন্ধ করা হয়েছে। বিশ্বে দুটি বড় বিপর্যয় ঘটেছে—কোভিড ও ইউক্রেনে যুদ্ধ। তাই আমরা তাদের কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারি না। কথা বলেও আমরা তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাব না। আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে।’