‘আমি আবারও একই কাজ করব’, মিয়ানমারের জেল থেকে এক শিক্ষার্থীর বার্তা

Looks like you've blocked notifications!
মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী প্রতিবাদে তিন আঙ্গুলের স্যালুট দিচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ছবি : এএফপি

ছাত্র অধিকারকর্মী লিন লিন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। তবে একপর্যায়ে তিনি ধরা পড়েন। আর এখন ১৫ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়েও তার কোনো অনুশোচনা নেই। বিচার চলার সময় বার্তা সংস্থা এএফপিকে ২৫ বছর বয়সী মনোবিজ্ঞানের ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে এই কাজটি আরও বেশি করতে চাই। তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর মুক্তির পর আমি কী করব? আমি বলব, আমি আবারও এটাই করতে চাই।’

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে ক্ষমতা দখল করে, তখন থেকেই হাজারো প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসেন লিন লিন। বিক্ষোভরত জনতার ওপর সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করে, গ্রেপ্তার করে হাজারো মানুষকে, পাশাপাশি চলে সন্দেহভাজন বিরোধীদের বাড়িঘরে রাত্রিকালীন তল্লাশি।

প্রতিবাদ বিক্ষোভের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে লিন লিন মানুষের মনে জান্তাবিরোধী অবস্থানকে স্থায়ী রূপ দিতে নতুন একটি উপায় খুঁজে বের করেন। হংকং ও অন্যান্য জায়গায় ফ্লাশমবের আদলে তিনি ইয়াংগুন ও তার আশপাশে প্রতিবাদের আয়োজন করতে শুরু করেন।

এই কাজে তিনি ম্যাসেজিং অ্যাপের সাহায্য নেন তার মতো আরও বেশ কিছু তরুণ প্রতিবাদীকে খুঁজে বের করতে। তারা একত্রিত হতো শপিং মল, পার্ক বা বাজারের সামনে। তারা প্রতিবাদ জানাতে ব্যবহার করতো ফ্লেয়ার, তুলে ধরতো প্রতিবাদী ব্যানার। তিন আঙ্গুলে স্যালুটের একটি প্রতীক এ সময় গণতন্ত্রপন্থিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া হ্যান্ড মাইকে জান্তা সরকারের সমালোচনাও করা হতো পথচারীদের শোনাতে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের আয়োজনে এই প্রতিবাদ জানানোর পরপরই প্রতিবাদীরা নিরাপত্তা বাহিনী আসার আগেই আশপাশের গলিতে বা অপেক্ষমাণ গাড়িতে করে পালিয়ে যেত। এসব ঘটনার পুরোটা ভিডিও করা হতো এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা হতো অথবা বিদেশে থাকা সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো হতো।

২০২১ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো লিন লিনের একটি সাক্ষাৎকার নেয় বার্তা সংস্থা এএফপি। এ সময় লিন লিন তার পরিবারকে বিদায় জানায়, আর গা ঢাকা দেয় আশি লাখ লোকের বাণিজ্যিক শহরে। কয়েকদিন পরপর নতুন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অবস্থান পাল্টানো তার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন সে তার দরজায় অনাকাঙ্ক্ষিত কড়া নাড়ার শব্দের অপেক্ষ করত। সে সময় লিন লিন এএফপিকে বলেছিলেন, ‘আমি সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না। সকালের রোদ দেখলেই আমি নিজেকে নিরাপদ বোধ করতাম। আর তারপরেই কেবল ঘুমাতে পারতাম।’

বিরোধীমতের লোকজনের ওপর এ সময় ব্যাপক অত্যাচার ও যৌন সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে কমপক্ষে ২৯০ জনের প্রাণহানি ঘটে দেশটিতে। এরকম একটি প্রতিবাদী ফ্লাশমবের ঘটনায় ২০২১ সালে সামরিক বাহিনী ভারী যান উঠিয়ে দিলে তিনজন গুরুতর আহত হয়। তবে এর কিছুদিন পরেই সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন লিন লিন। ২০২২ সালের মার্চে জান্তা নিয়ন্ত্রিত আদালত থেকে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভুয়া আইডি কার্ড রাখার দায়ে তাকে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে ২৬ হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এখন কেবল আদালতের শুনানির সময়ই লিন লিন তার আত্মীয়স্বজনের দেখা পান। আর এসময়ে তিনি দেশের উত্তাল সময়ের খবর পান তাদের কাছ থেকে। তবে গত মাসে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে তাকে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তবে লিনি লিন এখন আগের মতো কারাগারে দিনযাপনের হিসাব রাখেন না। অপেক্ষা করেন না মুক্তির দিনটির জন্য। এ বিষয়ে লিন লিন বলেন, ‘আমি বাড়ি যাওয়ার আগে আরও কত দিন এখানে থাকতে হবে, তা নিয়ে ভাবি না। আমি কেবল জান্তাবিরোধী বিপ্লবে জয়ের পরেই নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।’