আরজি করকাণ্ডের এক মাস : প্রতিবাদ, রাত-দখল, গ্রাফিতি, গোয়েন্দা কার্যক্রম
৯ আগস্ট শুরুর প্রথম ভাগেই দুর্ভাগ্যকে দেখেছিলেন মৌমিতা দেবনাথ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের চেস্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ছিলেন তিনি। ৮ আগস্ট দিনগত রাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। পরে তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তাও অর্ধগলিত। এরপর বিক্ষোভ হলো, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ক্লু খুঁজল, প্রমাণ লোপাটের আলামত পাওয়া গেল, বিক্ষুব্ধরা রাত দখলের কর্মসূচি করে গেল, চিঠি ফাঁস হলো; কিন্তু তারপরও দৃশ্যত বিচারকার্যক্রমের যে অগ্রগতি, তা অন্য সব সময়ের মতোই। যে কারণেই আরজি করকাণ্ডের মধ্যে আরও একটি ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু দেখল ভারত, যা ঘটেছে বিশ্বভারতীতে।
একমাসজুড়ে ভারতে বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান মৌমিতার ধর্ষক ও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। প্রতিবাদে-স্লোগানে তারা তাদের দাবির কথা জানিয়েছে। এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের নারী, শিক্ষার্থী, সাধারণ জনতাও পালন করে নানা কর্মসূচি।
গত রোববার দিনগত রাতেও শিলিগুড়িতে রাত দখলে ছিল ভারতের চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জুনিয়র ডাক্তার ফোরাম’। তাদের সঙ্গে ওই অবস্থানে যোগ দেন সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। নাচে-গানে প্রতিবাদে মুখর আন্দোলনকারীরা। আনন্দবাজার এই তথ্য জানিয়েছে।
আরও জানা গেছে, আসানসোলের ভগৎ সিং মোড়ে বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বাকবিতন্ডা হয়। আন্দোলনকারীরা ‘আজাদি, আজাদি’ স্লোগান দেওয়ার সময় বিজেপির কর্মীরা তাঁদের মাইক কেড়ে নেন। তার পরে তাঁরা দাবি রাখেন, এই স্লোগান দেওয়া যাবে না। যারা স্লোগান দিচ্ছিলেন তারা এই দাবি মেনে নেওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আসে। পরে সবাই মিলে আর জি কর কাণ্ডে দোষীর শাস্তির দাবিতে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন।
উত্তরপাড়া, চুঁচুড়া, মেদিনীপুর, হাওড়ায়, ব্যারাকপুর, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, পানিহাটি, কোচবিহার, বালুরঘাট, আসানসোলে পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি। তারা গ্রাফিতি, আরজি করকাণ্ডে অভিযুক্ত, হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের কুশপুতুল দাহ, রাত দখল, মশাল প্রজ্জালন, মানববন্ধন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছেন। আরজি কর-কাণ্ডের বিচারের দাবিতে পথ নাটিকাও করছেন নাট্য কর্মীরা। গান ও কবিতার মাধ্যমে করা হয়েছে আরজি করকাণ্ডের প্রতিবাদ ও চাওয়া হয়েছে দোষীদের শাস্তি।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ
শুধু কলকাতা নয়, বিশ্বজুড়ে ছিল বিক্ষোভ। আরজি করকাণ্ডে বিশ্বের ২৫টি দেশের ১৩০ শহরে বিক্ষোভ হয় বলে জানিয়েছে জার্মান ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে। বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ছিল বেশ বড়সড়। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের সামনে ভারতীয়রা বিক্ষোভ করেন।
অধ্যক্ষ সন্দীপ গ্রেপ্তার, কুশপুত্তলিকা দাহ
এই আরজি করকাণ্ডে এরইমধ্যে কলেজটির অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আর্থিক দুর্নীতি মামলায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। বিক্ষুব্ধরা বিভিন্ন স্থানে সন্দীপের কুশপুতুল দাহ করেছে।
এ ছাড়া বর্ধমান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস এবং প্রাক্তন আরএমও অভীক দে-কেও সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ভবন। তারা দুজনেই আরজি কর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ‘ঘনিষ্ঠ’।
অপরাধস্থলের খোঁজে গোয়েন্দারা
আরজি করে অপরাধস্থল কোথায়—তা নিয়ে চলছে সিবিআইয়ের নজরদারি। ঘটনাস্থলের খোঁজে সিবিআই সূত্র বলছে, আরজি কর মেডিকেল কলেজের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের তিন-চারটি ঘর নজরবন্দি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। সেমিনার হলের লাগোয়া একটি ঘর, শৌচাগার এবং তারও ভিতরে একটি ঘর তদন্তকারীদের নজরে রয়েছে। এর মধ্যে সেমিনার হল লাগোয়া ঘরটি এবং শৌচালয় ভেঙে ‘মেরামতির’ কাজ শুরু হয়েছিল ডাক্তার ছাত্রীর খুন ও ধর্ষণের ঘটনাটির কয়েক দিনের মধ্যে। কিন্তু ভিতরের অন্য একটি ঘরে অপরাধের কিছু সূত্র থাকতে পারে বলে সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের সূত্রে জানা যাচ্ছে। ওই ভিতর-ঘরে রোগীদের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হত। কিন্তু কাউকে ভর্তি করা হত না বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। তবে ঘরটিতে রোগীর জন্য ‘বেড’ রয়েছে। ওই ঘরেই অপরাধের প্রকৃত ঘটনাস্থল হওয়ার সম্ভাবনা সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের একাংশ উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
চিঠি ফাঁস, সেখানে আরজি করে ঘর ভাঙার নির্দেশদাতার নাম
আরজি কর হাসপাতালের চারতলার সেমিনার রুমে পাওয়া গিয়েছিল চিকিৎসকের দেহ। সেই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর দেখা যায় পিডাব্লিউডি সেমিনার রুমের লাগোয়া একটি ঘর ও বাথরুম ভাঙতে শুরু করেছে। সেই সময়ই অভিযোগ ওঠে, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় এই কাজ করা হয়েছে। ডিডাব্লিউর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীও এই কথা বলেন। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠছে, কে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন?
টিভি৯ বাংলা সেই নির্দেশের প্রতিলিপিসহ জানিয়েছে, সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে, এই চিঠির সত্যতা ডিডাব্লিউ যাচাই করে দেখতে পারেনি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, চিঠিতে সন্দীপ ঘোষ লিখিতভাবে এই ঘর ভাঙার অনুমতি দিয়েছেন।
সন্দীপ ঘোষকে এখন সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। তবে, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন এই চিঠির পর তার বিরুদ্ধে চিকিৎসক হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থা করে কি না, তা জানা যায়নি।
গত শুক্রবারও ইডির কর্মকর্তারা কলকাতায় সন্দীপ ঘোষের বাড়িতে তদন্তের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি তালাবন্ধ দেখে তারা ফিরে আসেন। ইডি হাওড়ায় বিপ্লব সিংহ এবং কৌশিক কোলের বাড়িতে এবং সুভাষগ্রামে প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে তল্লাশি করছে।
সূত্র জানাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীদের ধারণা হয়েছিল, সন্দীপ ঘোষের নির্দেশে পিডাব্লিউডি সেমিনার রুমের পাশের ঘর ভাঙার কাজ করছিল। কিন্তু, তখন এই চিঠি পাওয়া যায়নি। এখন সেই চিঠি পাওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে,এই কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য সন্দীপ ঘোষ কতটা ব্যাগ্র ছিলেন।
যে চিঠিটা সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সন্দীপ ঘোষ পূর্ত দপ্তরের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে ১০ অগস্ট একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারদের রুম ও তার টয়লেট বানানোর কথা বলেছিলেন। সেখানে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, ডাক্তারদের উপযুক্ত রুম ও টয়লেটের অভাব রয়েছে। একাধিক বিভাগেই এই সমস্যা রয়েছে। রেসিডেন্ট ডাক্তারদের অনুরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
চিঠিতে এটাও লেখা হয়েছিল, এই বিষয়টি স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও ডিরেক্টর মেডিকেল এডুকেশনের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আরজি করের বোর্ড রুমে সেদিনই যে ওই বৈঠক হয়েছে, সেটাও চিঠিতে বলা হয়েছে।
১৩ অগাস্ট বিকেলে হাইকোর্ট সিবিআই নির্দেশ দেওয়ার আগে পিডাব্লিউডির কর্মীরা সেমিনার রুমের পাশের ঘরে কাজ করে বলে অভিযোগ আছে। সুবর্ণ গোস্বামী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমরা প্রথম থেকে দাবি করে আসছিলাম, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তৃপক্ষ এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
টিভি৯ ও হিন্দুস্তান টাইমসের বরাতে ডয়চে ভেলে তাদের প্রতিবেদনে আরও বলেছে, বিজেপি নেতা ও মিডিয়া সেলের প্রধান অমিত মালবীয় এই চিঠিটি টুইট করে বলেছেন, এটা বিস্ফোরক। তার দাবি, ‘বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা কথা বলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, সেমিনার রুমের পাশের ঘর ভাঙার কাজ ধর্ষণ ও হত্যার আগে থেকে শুরু হয়েছে। এমনকী যারা ভাঙা দেওয়ালের ভিডিও শেয়ার করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কলকাতা পুলিশ মামলা দায়ের করেছে।’