ক্ষুধার রাজ্যে পরিণত হয়েছে গাজা, উপচে পড়ছে হাসপাতাল

দুই বছর বয়সী মেয়ার, হাসপাতালে একটি বেডে শুয়ে আছে। তার পাঁজরের হাড় বেরিয়ে এসেছে, পেট ফোলা। মেয়ের দুর্বল হাত ধরে শার্ট পরিয়ে দিচ্ছিলেন মা আসমা আল-আর্জা। বেডে শুয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
এই প্রথম নয়, আগেও অপুষ্টির কারণে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে গাজা উপত্যকার এই নিষ্পাপ শিশুটিকে। তবে এবারই টানা ১৭ দিন ধরে বাচ্চাটি হাসপাতালে রয়েছে বলে জানান তার মা।
মেয়ারের সিলিয়াক ডিজিজ নামের একটি বিশেষ রোগ রয়েছে। এ কারণে গ্লুটেনজাত খাবার খেতে পারে না সে, তার জন্য বিশেষ খাবারের দরকার হয়। কিন্তু ১৯ মাসের যুদ্ধ আর ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের কারণে গাজায় এই খাবার এখন আর নেই। সাধারণ খাবারও সে হজম করতে পারে না।
মেয়ারের মা বলেন, ‘ডায়াপারের পাশাপাশি ওর সয়ামিল্ক আর বিশেষ খাবারের দরকার। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ থাকায় এগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম, আমি কিনতে পারি না।’
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গাজায় ৯ হাজারের বেশি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। আগামী বছর এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েল যদি সামরিক অভিযান বন্ধ না করে এবং গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর আরোপিত অবরোধ পুরোপুরি না তুলে নেয়, তাহলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে বারবার সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে গাজায় অনেক মানুষ খাবার পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ফিলিস্তিনি অঞ্চলের প্রতিনিধি নেস্টর ওয়োমুহাঙ্গি বলেন, ‘গাজার যেদিকে তাকাবেন, ক্ষুধার্ত মানুষ চোখে পড়বে। সবাই ইশারায় দেখান যে তারা খেতে চান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি চলছে।’
টানা অবরোধে টান পড়েছে ত্রাণে
সবশেষ গত ২ মার্চ গাজায় সব ধরনের খাদ্য, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইসরায়েল। প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস এই অঞ্চলে। একের পর এক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের সঙ্গে চলছে এই অবরোধ।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাজার মানুষ বাইরের সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কারণ ইসরায়েলের হামলায় স্থানীয়ভাবে খাবার উৎপাদনের প্রায় সব ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
অবরোধের পর গাজার খাদ্যসংকট নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে প্রথমদিকে ইসরায়েল দাবি করেছিল, গাজায় পর্যাপ্ত খাবার আছে। তবে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর চলতি সপ্তাহে গাজায় সীমিত পরিসরে শিশুখাদ্যসহ মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেয় ইসরায়েল।
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েল যেটুকু সহায়তা প্রবেশ করতে দিয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। অবরোধের আগে প্রতিদিন প্রায় ৬০০টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করত। বর্তমানে যা প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, তা আগের সংখ্যার ধারেকাছেও নয়।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থার সদস্য টেস ইনগ্রাম বলেন, এরই মধ্যে গাজায় শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যেতে শুরু করেছে। যদি দ্রুত পুষ্টিকর খাবার না পৌঁছায়, তাহলে আরও অনেক শিশু প্রাণ হারাতে পারে। তাছাড়া, সামরিক নিয়মকানুন ও গাজার অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় সহায়তা ঠিকঠাক পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।

গত বুধবার (২১ মে) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেন, মধ্য গাজায় কয়েকটি গুদামে ১২টির বেশি ট্রাক পৌঁছেছে। অবরোধ কিছুটা শিথিল হওয়ার পর এটিই প্রথম সহায়তা যা সরাসরি বিতরণের জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে।
এদিকে হামাস সদস্যরা ত্রাণ আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে ইসরায়েল, যদিও তারা এই বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এমনকি ত্রাণ বিতরণের নতুন পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নতুন পরিকল্পনায় হামাস যোদ্ধারা যাতে খাবার না পায়, তা নিশ্চিত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। যদিও নেতানিয়াহুর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য ত্রাণদাতা সংস্থাগুলো।
এদিকে অনবরত হামলার কারণে এত এত আহত মানুষ নিয়ে চরম সংকটে পড়েছে গাজার হাসপাতালগুলো। সেখানকার খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সবসময় রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়।
খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালে কাজ করা ডা. আহমেদ আল-ফারাহ বলেন, ‘আমাদের এখানে কিছুই নেই। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য জরুরি কেন্দ্রটিতেও আর জায়গা নেই। খাবারের সরবরাহ ফুরিয়ে আসছে, মানুষ এখানে উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। নবজাতক ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই পরিস্থিতি ভীষণ ভয়াবহ।’
খাবারে পানি মিশিয়ে বেশি দিন চালানোর চেষ্টা
হাসপাতালের খাবার কেন্দ্রে দেখা যায়, অপুষ্টিতে আক্রান্ত মায়েরা তাদের ক্ষুধার্ত সন্তানদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কারও কারও পিঠের হাড় চামড়া নিচে ফুটে উঠেছে, পায়ের পেশি ফুলে গেছে।
বিশ্বের প্রধান খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, আগামী বছরের মার্চের মধ্যে গাজায় প্রায় ৭১ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। পাশাপাশি প্রায় ১৭ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েরও চিকিৎসার দরকার হবে।
মাই নামলে নামে এক নারী তার ১৮ মাসের ছেলেকে নিয়ে একটি তাঁবুতে থাকেন। তারা দুজনেই অপুষ্টিতে ভুগছেন। তিনি ছেলেকে বুকের দুধ ছাড়াতে চেয়েছিলেন, কারণ তার শরীরে আর দুধ নেই বললেই চলে। কিন্তু শিশুটিকে খাওয়ানোর অন্য কিছুও নেই।
তিনি ছেলেকে অনেক বেশি পরিমাণে পানি মিশিয়ে গুঁড়ো দুধ খাওয়ান, যাতে গুঁড়ো দুধ আরেকটু বেশি দিন চলে। কখনও কখনও ক্ষুধা থামাতে শস্যজাতীয় খাবারও খাওয়ান।
মাই বলেন, ‘আমি এটিকে দুধ বলে চালানোর চেষ্টা করি, যাতে আমার ছেলে না কাঁদে।’
তিনি জানান, তাকে ৩০টি পুষ্টিকর সাপ্লিমেন্ট দিয়েছিল এক ত্রাণ সংস্থা। কিন্তু তা দুই দিনেই ফুরিয়ে যায়। কারণ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে তাকে সেগুলো ভাগ করে নিতে হয়।
আরেকটি তাঁবুতে নুফ আল-আর্জা নামে এক নারী জানান, এক কেজি মসুর ডাল কিনতে অনেক টাকা খরচ করেন তিনি। ওই ডাল তিনি অনেক পানি দিয়ে রান্না করেন, যাতে বেশি দিন চলে।
নুফ বলেন, ‘আমরা পরের দিন কী খাব তা জানি না। চার সন্তানের মা আমি। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে এর মধ্যেই ২৩ কেজি ওজন কমে গেছে। এখন প্রায়ই মাথা ঘোরায়, মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না।’
ডাক্তাররা জানান, নুফ ও তার তিন বছর বয়সী মেয়ে, দুজনেই অপুষ্টিতে ভুগছেন। তার চার মাস বয়সী ছেলেটিও কম ওজন নিয়ে জন্মেছে। তিনি দুধ দিতে কষ্ট পাচ্ছেন।
নুফ বলেন, ‘আমি সারাক্ষণ বাচ্চার জন্য একটু খাবার খুঁজি, যাতে তাকে খাওয়াতে পারি। কিন্তু কিছুই পাই না।’

এদিকে গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে নতুন করে হামলা শুরু করার পর থেকে গাজাজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ইসরায়েলিবাহিনী। সবশেষ গত রোববারের ভোরে চালানো বিমান হামলায় অন্তত ১০৩ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
ইসরায়েলের দাবি, হামাস একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে তাদের কাছে জিম্মি থাকা সব বন্দিকে মুক্তি দিক। অন্যদিকে হামাস চাইছে গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার, তাদের দাবি স্থায়ী সমাধান।
দুই পক্ষের কেউই নিজের অবস্থান থেকে ছাড় দিতে রাজি নয়; এতে দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারণ গাজাবাসীর।
এ বিষয়ে আবু মোহাম্মদ ইয়াসিন নামে জাবালিয়া এলাকার বাসিন্দা বলেন, যখন ইহুদিরা যুদ্ধবিরতি চায়, তখন হামাস তা প্রত্যাখ্যান করে; আবার যখন হামাস যুদ্ধবিরতি চায়, তখন ইহুদিরা তা মানে না। উভয় পক্ষই ফিলিস্তিনি জনগণকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর।
একরাশ হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর দোহাই, আমাদের প্রতি দয়া করুন। বারবার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাতে পালাতে আমরা ক্লান্ত।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছের উপত্যকার প্রায় ৯০ শতাংশ বাসিন্দা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর পরিমাণই বেশি।