সেলিম আল দীন : শিল্পপথের একক পথিক
‘তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ’ অথবা ‘গঠিত হই শূন্যে মিলাই’—নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাঁর শিল্পপথ কিংবা মানবীয় বোধটাকে এমন করেই প্রকাশ করতেন।
আমাদের এই শিক্ষাগুরু একান্ত নিজস্ব ঘরানার নাট্যদর্শন বিনির্মাণে যে পথ রচনা করেছিলেন, সেই পথের পথিক তিনি একাই ছিলেন। চিন্তার মহত্বে মানুষের মুক্তির যে গান তিনি শুনিয়েছেন, সেই সংগীতের তিনিই একমাত্র শিল্পী। শিল্পসখা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, শিমুল ইউসুফ, হুমায়ূন ফরীদি এবং আফজাল হোসেনের মতো কিছু শিল্পপথিক এতে দোহারকি করেছেন সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেলিম আল দীনের কথকতা ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদী বর্ণাত্মক শিল্পরীতি একান্তই তাঁর একার। অনেকটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’র মতো।
বিশ্ব থিয়েটারের বিচিত্র ও বিস্ময়কর ভূগোল পাঠ সেলিম আল দীনের কাছ থেকেই পেয়েছি। জেনেছি সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপার সিন্ধু। স্যারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিটি রাস্তা, জঙ্গল, ঝোপঝাড় ও অলিগলিতে ঘুরেছি। চিনেছি বৃক্ষের সৌন্দর্য-প্রাচুর্য, পাখপাখালির বিচিত্র সুর এবং প্রকৃতির অমোঘ লীলা। আমাদের সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতিতে পরিপুষ্ট সেলিম আল দীন আমৃত্যু প্রান্তিক মানুষের শিল্পানুসন্ধান করেছেন। শহুরে নটরাজদের গ্রামীণ মানুষের জীবনবাদিতায় দীক্ষা দিয়েছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্ববীক্ষা ও আপন স্বাজাত্যবোধ। সন্ধান দিয়েছেন হাজার বছর বয়সী শেকড়ের।
ক্যাম্পাসে স্যারের সান্নিধ্যে যত দিন কাটিয়েছি, তত দিন তো বটেই; এখন অবধি বিদ্যাশ্রমের প্রতি ভালোবাসার টান ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনবিষয়ক আবেগ ও অনুভূতি পুরোটাই যেন একজন শিক্ষক ও পরম বন্ধু সেলিম আল দীনেরই উপহার। সেই পরম উপহার আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে, আমার শিক্ষাস্বর্গে বার বার ফিরবার আকুতিটা জাগিয়ে রাখে।
শিল্পতীর্থের সহযাত্রী মাত্রই স্যারের লেখা নাটকের সাথে পরিচিত। ‘শকুন্তলা’, ‘বনপাংশুল’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসী’, ‘নিমজ্জন’, ‘হাতহদাই’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘চাকা’, ‘ধাবমান’সহ আরও অসংখ্য নাটক লিখে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছেন। লিখেছেন বিস্তর টিভি ও রেডিও নাটক। পণ্যের বিজ্ঞাপনের কপিরাইটিংয়েও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
স্যার আজীবন একটি একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখবোধ বয়ে বেড়াতেন। তিনি এই বিয়োগব্যথা নিয়ে লিখেছিলেন ‘পুত্র’ নামের অমর ট্র্যাজিক উপাখ্যান। ২০১৮ সালে ঢাকা থিয়েটার নাটকটি মঞ্চে আনে।
ওই নাটকের নির্দেশক শিমুল ইউসুফ বলেছিলেন, ‘পুত্র সেলিম আল দীনের শেষ দিকের নাটক। এখানে সেলিম আল দীনের কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার শিল্পের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। নিজের যে কষ্টগুলো ছিল, যে পুত্রশোক ছিল, সেগুলো শিল্পের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল। ২০ মিনিট পর সে মারা যায়। সেই সন্তানের শোকটা আমি পুত্র নাটকে দেখেছি। পারুল ভাবির (সেলিম আল দীনের স্ত্রী) যে কষ্ট ছিল, সেটা আমি আবছার ভেতর দেখতে পাই। সিরাজ মাইট্টালকে আমার মনে হয় সেলিম আল দীন। তিনি নিজের জীবনকেই এই গল্পের মাধ্যমে বলে দিয়েছেন।’
শিক্ষক হিসেবে প্রফেসর ড. সেলিম আল দীন অতুল্য ও অদ্বিতীয়। ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। আর লিখতে লিখতেই একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, মুনির চৌধুরী সম্মাননা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিবিধ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
আজ (১৮ আগস্ট) সেলিম স্যারের ৭২তম জন্মজয়ন্তী। আমাদের হার্দিক শ্রদ্ধার্ঘ্য স্যারের অমর ও অবিনশ্বর স্মৃতির প্রতি।
২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট রবীন্দ্রোত্তর কালের বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার সেলিম আল দীন ৫৭তম বর্ষে পা রাখেন। স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে তৎকালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেটি ছাপা হয়েছিল স্যারের জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। সেটি হুবহু পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল স্যার প্রয়াত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। সাক্ষাৎকারটি ছিল আমার পক্ষ থেকে স্যারের জন্য জন্মদিনের উপহার। সামান্যেই খুশি হতেন স্যার, তবে তা প্রকাশ করতেন না।
আমরা তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল প্রোডাকশন করছি। স্যারের নির্দেশনায় শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, তাও আবার মূল ইংরেজি ভাষায়। এ উপলক্ষে স্যারের সাথে অল্পবিস্তর খাতির হতে শুরু করেছে। তো একদিন সুযোগ বুঝে স্যারকে বললাম, জন্মদিন উপলক্ষে আপনার বর্তমান নাট্যভাবনা নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে চাই। স্যার খানিক ভেবে বললেন, তুই পারবি? আমি মাথা আনত করে বললাম, স্যার, আমি পারব। আচ্ছা প্রশ্ন তৈরি করে আগেই আমাকে দিস। আর শোন, কাল বিকেলে আমি ফোন দিলে আমার সাথে হাঁটতে বের হবি... একনাগাড়ে বলে গেলেন স্যার।
একটা বিষয়ে খুব মন খারাপ হলো, স্যারের সাথে সারা ক্যাম্পাস হাঁটতে হবে তাই। স্যার হাঁটার শিষ্যসঙ্গী পেলে তাকে আর সহজে ছাড়তে চাইতেন না! সঙ্গত কারণেই আমরা অবোধ ছাত্ররা স্যারের সাথে হেঁটে সময় পার করতে চাইতাম না! কিন্তু শিক্ষার্থী সহযোগে হাঁটা ও জ্ঞান বিনিময়টা স্যারের নিজস্ব ব্র্যান্ড ছিল। পরের সাত দিন হাঁটলাম। স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার নিজ হাতে চা করে খাওয়ান। কিন্তু আমার সাক্ষাৎকারের খবর হয় না। অথচ প্রশ্ন ও একটা সনি টেপ রেকর্ডার আমার প্যান্টের পকেটেই থাকে। যা হোক জন্মদিনের তিন দিন আগে স্যার বাসায় ডেকে তৎক্ষণাৎ পাওয়া আমার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলেন।
সেদিন অনেক প্রশ্নের মধ্যে বাংলাদেশি টেলিভিশন নাটক প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, প্রেমের অবিরল উপস্থাপনা প্রত্যেকটি নাটকে। যা ম্লান বা পাণ্ডুর একটা কালকে উপস্থাপন করে। জীবনের প্রধান প্রবণতা তো প্রেম নয়। জীবনের আরও অনেক অনুষঙ্গ আছে। চ্যানেলের নাটকগুলো দেখলে মনে হয় ওটাই যেন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—যুবক-যুবতীদের সম্পর্ক। তিনি আরও বলেছিলেন, আরেকটি অশনিসংকেত হলো—প্রতিবেশী দেশের সিরিয়ালগুলোর খুব বাজে প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের নাটকগুলোতে।
পাঠ্য হিসেবে থিয়েটার বিষয়ে স্যার বলেছিলেন, যারা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কলেজগুলোতে থিয়েটার পাঠ্য করবে, তারা নিশ্চিতই ছেলেমেয়েদের একটা ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারবে।
জীবন সম্পর্কে স্যারের উপলব্ধি ছিল, জীবন ক্রমেই মৃত্যুর দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে। দেশ সম্পর্কে স্যার বলেছিলেন, এক কথায় বলব আমার দেশের চেয়ে ভালো দেশ, সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই।
স্যার ভোরে সূর্য উদিত হবার আগে আমাদের মতো নগণ্য শিষ্যদের সাথে ক্যাম্পাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হেঁটে বেড়াতেন। ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধতা দেখতেন, মহুয়ার গন্ধে মাততেন। পাখপাখালির সুরশব্দ আর রঙে মুগ্ধ হতেন। ভোরের দূর্বা কুয়াশায় নিজের পদযুগল ভিজিয়ে শিশুদের মতো মজা পেতেন।
সেলিম স্যার বলতেন, একটা ক্ষয়ে যাওয়া দিবসের মৃত্যু শেষে পরদিন নতুন দিন নিয়ে আসা ভোরের সূর্য যে দেখেনি, তার কাছে পৃথিবীর রূপ পুরোটাই অধরা। আচার্য সেলিম আল দীনের মতো এমন করে এত সুন্দর ও সত্য কথা আর কে কবে বলতে পেরেছেন!
স্যার তাঁর গবেষণা, নিরীক্ষা, লেখালেখি ও অধ্যাপনায় অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। বলতেন, মানব অসম্ভবের কালে কী সব চিত্র বহন করে চলেছেন। বিশ্বাস করতেন, ‘সে কোন মহাকবির দীর্ঘশ্বাস থেকে জন্ম আমার/ অন্ধতামসী ফিরছি একা একা মৃত সিন্ধু তীরে।’
স্তোত্র ‘নিজের রচনা বিষয়ে’ সেই কথাটিই পরিষ্কার করে বলে গিয়েছেন :
সহসা তাকিয়ে দেখি বিশাল আকাশ প্রাচীন কালের
রয়েছে আজও তাই অসীম বিশ্বাসে পথে চলি—
যতই এগোই আর থাকে না ক্লান্তিভার তোমার সে দায়
একাকী করছি বহন নক্ষত্র চিহ্ন দেখে পৌঁছে যাব ঠিক
একদিন
লেখক : সাংবাদিক