আজ লাল মিয়ার জন্মদিন
গ্রামের সবাই তাঁকে লাল মিয়া বলেই চিনত। অসাধারণ আঁকার হাত ছিল তাঁর। গরিব সংগ্রামী মানুষের জীবন তুলির টানে রূপ পেত তাঁর ক্যানভাসে। বাংলার মানুষের মনে তিনি ছিলেন যথার্থই সুলতান। তিনি আর কেউ নন, আমাদের চিরপরিচিত এস এম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। এমনই এক আগস্ট মাসের ১০ তারিখে ১৯২৩ সালে নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন।
আমাদের পৃথিবীটাই একটা পটে আঁকা ছবি। এই ছবিকে পেনসিলের টানে সাদা পাতার ক্যানভাসে জীবন্ত করে ধরে রাখতে পারেন যাঁরা, তাঁরা সমাদৃত হন চিত্রশিল্পী বলে। বাংলাদেশে বিশ্ববরেণ্য যে কয়জন চিত্রশিল্পীর নাম করা যায়, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন এস এম সুলতান। অপূর্ব তাঁর চিত্র, অসাধারণ তাঁর রেখার টান। বিশ্বে এমন চিত্রশিল্পী খুব কমই আছে, যাঁর তুলির প্রতিটি টান জীবন্ত হয়ে কথা বলে। দরিদ্র কৃষক শেখ মোহাম্মদ মেসের আলীর পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ১৯২৮ সালে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। পড়া ছেড়ে যোগ দেন বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজে। ইমারত তৈরির কৌশল ও কারুকাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হতেন।
এ কাজের ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে যেতেন আঁকাআঁকিও। ১০ বছর বয়সে স্কুলে তাঁর পেনসিল স্কেচের একটি ছবি দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন শ্যামপ্রসাদ মুখার্জি। সেখান থেকেই তাঁর শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। নিজ গুণে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ রায়, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের। কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েও সেখানকার গণ্ডিবদ্ধ জীবন তাঁর বোহেমিয়ান চিত্তকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নিজ হাতে চিত্র এঁকে সৈন্যদের কাছে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। এ সময় তাঁর আঁকা কোনো ছবিই আজ পাওয়া যায় না। অসাধারণ প্রতিভাবান এই শিল্পী জীবন সম্পর্কে খুব উদাসীন ছিলেন বলেই নিজের অপূর্ব, মূল্যবান কর্মকে সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব করেননি কখনো। তবে চিত্র প্রদর্শনীর জন্য তিনি গিয়েছিলেন নিউইয়র্ক, শিকাগো, বোস্টন, করাচিতে। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গ্রামে গড়ে তোলেন ‘শিশু স্বর্গ’, ‘চারুপাঠ’, ‘নন্দনকানন’ নামে শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দেশকে তিনি ভালোবাসতেন। জীবনকে তিনি দেখেছিলেন গভীর থেকে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপট, কৃষকদের শ্রম ও জীবনের সংগ্রাম তাঁকে মুগ্ধ করত; কৃষকদের ওপর জুলুম ও অত্যাচার তাঁকে ব্যথিত করত। তাঁর শিল্পকর্মের রূপটি তাই তৈরি হয়েছিল গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে। তিনি দেখেছেন রুগ্ণ গরু নিয়ে শীর্ণকায় কৃষককে মাঠে কাজ করতে; কিন্তু তাঁর চিত্রে তিনি এঁকেছেন বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান কৃষক ও হালের গরুর ছবি। তাঁর অঙ্কন দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, কেন আমাদের কৃষকরা কৃশকায়? কেন যাঁদের হাতে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তাঁরা অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকবে? তাঁদের তো বলিষ্ঠ হওয়ারই কথা ছিল। শুধু গ্রামের শ্রমজীবী কৃষকই নন, তাঁর ছবিতে গ্রামীণ নারীরা সুঠাম, সুডৌল গড়ন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, যা তাঁদের রূপ-লাবণ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় শক্তি আর সামর্থ্যকে। তিনি তাঁর চিত্রের মাধ্যমে এক ধরনের প্রতিবাদ ফুটিয়ে তোলেন। স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে তিনি এমন চিত্র আঁকেন, যা মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।
তাঁর চিত্রের প্রেরণাই ছিল এ দেশের কৃষক ও কৃষকের জীবন চেতনা। এ ছাড়া তাঁর চিত্রে ফুটে ওঠে গ্রামের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক অবিচার ও শ্রেণিশোষণের ভয়াবহ চিত্র। ১৯৮৭ সালে অঙ্কিত ‘হত্যাযজ্ঞ’, ১৯৮৮ সালে অঙ্কিত ‘চরদখল’ নামে চিত্রকর্ম এই অত্যাচার-অবিচারের স্পষ্ট ছবি তুলে ধরে।
এই মহান শিল্পী নিজের জনপ্রিয়তা নিয়ে কখনো চিন্তা করেননি। আঁকার পাশাপাশি তিনি সুর-সাধনা করতেন। ভালোবাসতেন বাঁশি বাজাতেও। ১৯৮২ সালে তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মান পুরস্কার ও ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। ২০১০ সালে আমিরুল ইসলাম নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে ‘লাল মিয়া’ নামে এস এম সুলতানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই লাল মিয়া আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাঁর অসাধারণ চিত্রকর্ম আমাদের অমূল্য সম্পদ।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।