নতুন বই থেকে কবিতা
ওই শীতের কথা মনে আছে, দেয়ালঘেরা উদ্যানে ওই শুষ্ক রেখাগুলো যেন শূন্যে চেয়েছে প্রার্থনা; মেঘবৃষ্টি, ঝুমঝুম, আর কেকা মিলনের অস্পষ্ট ধনি, বা এমনও হতে পারে, তার হৃদয়ে ফুল ফোটার ঋতুতে ফুল ফোটে;
আমরা দু’জন হেঁটে হেঁটে চলি, ছায়ারৌদ্রে পাতাঝরা পথে, কথা হয় সামান্যই, যার যার কথা বেশিরভাগ নিজের সঙ্গেই বলা;
আমি কি আশ্চর্য হতে পারি মৌতাত ছাড়া? বা জুয়ার কোর্ট ছাড়া মুঠোয় নিতে পারি উত্তেজনা? সঙ্গিনী এইসব জানে না-এই অরণ্যে, তার কামিনী ফুটতে দেব?-সে তলপেটে ঘুমন্ত রেখেছে করতালি;
ওই শীতের কথাই মনে আছে-এরপর তো বসন্ত, চড়–ইস্নানের জলও পেয়েছে রেখাগুলো, হাতে হাতে পেয়ে গেছে হলুদ খাম, ফুলআঁকা কাগজ উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায়, এমন একটা চিঠি অসতর্কে ধরে ফেলবে তুমিও-না জানি আবার ভুল প্রেমিকার ভর্ৎসনা কি না!
এই ভেবে ভেবে, যাই যাই বসন্ত, ওষুধ খেয়ে খেয়ে শুধু ঢুলছি
***
তুমি যে এলে বৃষ্টি দেখেছো? ঝমঝম রেলগাড়ির নিচে ওই লোহার হৃদয় ছুঁয়ে? কুলি আর চোরাগোপ্তা কিশোরের মুখে?
শুধু হাত বাড়ালে-এই ট্যাক্সি? আঙুলের ডগায় কি লেগেছে বৃষ্টি? পায়ে জলকাদা?
ওদিকে হয়তো বৃষ্টিই নেই। ক্রমাগত নীল জ্বলছে প্রিজম-ময়ূরে। যেন শাল-সেগুনের ডালপালা ভেঙে ভাবছো সহজেই চিনে নেবে পথ।
আমাদের গ্রাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বসে আছে। হাতে ধানের চারা, একটু থামলেই নেমে পড়বো। আরো বৃষ্টি হবে? তোমাদের কাগজে কী বলে? নালায় পুঁটি-খলসের লাফালাফি থেমেছে। ছেলেমেয়েদের নাকে সর্দি, খুশখুশে কাশি। ঘরের মাচায় গরু-ছাগলও আছে কষ্ট করে।
যদি বৃষ্টি না-ও থামে, ভেবো না, নৌকা পেয়ে যাবে একটা, শিমুলপুর বেশি দূরে নয়, দেখবে দুটো তালগাছ গ্রামের মাথায় দিনরাত জেগে আছে, পথে দুটো সাঁকো পেরুতে হবে, হাতল নেই, অবশ্য ভেসে গেছে কিনা জানি না।
এমন গ্রামে বেড়াতে যাবার কথা তুমি লিখেছো। অথচ তোমার ট্যাক্সি সেই যে আসছে আসছে আসছে-আমি কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছি ১৫/বি ঝুমকো লতার সামনে।
***
সারা দিন রৌদ্রে ধুলো, ধুলো; সন্ধ্যায় হ্যাজাকের নিচে ফুটছে জল, যত না চায়ের পিপাসা, ভেতরে বাঘিনীর ছোপছোপ, ফুঁ দিয়ে দিয়ে তাতিয়ে রাখি তার গন্ধ;
আমার তো উপাস্য নেই, কাকে বলি সন্ধ্যাকে বাঁধো তুমি প্ররোচনায়, শুধু ব্যয়িত হতে জোয়ার তো ছেনে যায় না নৌকার হৃদয়;
ফিরে গেলে যে বিছানা-তা যে হারানো মায়ের অসুস্থতা ঘাম আর ঘৃণায় নিভে আছে-আমি চিৎকার করে ওই বৃদ্ধ রাতকে বলি, তোমার খুচরো পয়সাভরা আকাশের তলে আমি উটের মতো নিজের ভেতর থেকে পান করি;
দৃশ্যত তা নারীসংগ্রহ থেকে অনেক ফসফরাস
***
এই রাস্তা হোটেলের দিকে গেছে। সামনে রেলক্রসিং, অসহ্য যানজট। কতদিন বিরক্ত হয়ে নেমে গেছি রিকশা থেকে। ওই হোটেলে আমি শীতল ড্রয়িংরুমে গল্প করি তপ্ত নারীদের সঙ্গে। এরা আমাকে নিয়ে রুমে যেতে চায়। আমি বলি, ‘সমঝোতা করে নাও, কে যাবে’-এরই মধ্যে যার সাথে আমার বেশি ভাব হয়েছে, তাকেই ওরা ঠেলে দেয়। যেন সে কতকালের ভালোবাসাবাসি!
আমি নিজের রক্ত পোড়াতে সিগারেট জ্বালাই। দু’একটা টান দিয়ে ওর হাতে দেবার ভঙ্গি করি, দেই না; শুরু হয় আবার আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি। ও ধৈর্যহীন হয়ে বলে, ‘চলো, রুমে চলো।’
আমি জানি, এরা দরোজার বাইরে যতটা উত্তেজক, ভেতরে কাফন খুলে আসা ঠান্ডা শরীর।
এই হোটেলের চারপাশে তরি-তরকারি লুটোপটি খায়। কচি লাউ থেকে ধনে পাতা, সব পাবেন : পেঁয়াজের ঝাঁজালো গন্ধ আর রৌদ্রের নিচে শূন্য ট্রাক।
***
বিষাক্ত না হলেও চলে
সাপ হতাম
আমি পায়ে পায়ে হেঁটে ক্লান্ত। এবার বুক ঘষে চলে দেখি।
ওই ঘাস লতাপাতার ফাঁকে। ব্যান্ডেজ ফেলে যাই
শিরদাঁড়া কোথায় রাখি?
চলো
ওই ইঁদুরের ঘরে
চলো
***
জিভের তলায় লুকিয়ে নিয়েছি ব্লেড
চলো যাই নিশ্চুপে
পাবে, তোমার পায়ের কাছে
অন্ধকারে
ওই তো ঠোঁট নড়ে উঠলো। একটু থামি।
-এমন দ্বিধা জাগে মৃতের শরীর দেখে
***
আমারও চোখে আছে জল
যা নয় কৈশোরিক
কে বাড়ায় হাত?
সন্ধ্যায় মত্ত রঙিন লণ্ঠন
তবু তারা যোনির কথা ভোলে না
আমি দেখি তিনটি অস্পষ্ট আয়না
হয়ত নড়েছিল ঠোঁট
অসফল বিদায়
টা টা
(কবি প্রকাশনী থেকে একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে জাহিদ সোহাগের ষষ্ঠ কবিতার বই। বইটির নাম বা কবিতার কোনো শিরোনাম নেই। কবির স্বাক্ষর দিয়ে প্রচ্ছদ করেছেন নরোত্তম দুবে। ২৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে ৫২টি কবিতা আছে। স্টল নম্বর ৬৪৪।)