জহির : একটি চেতনা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2018/08/19/photo-1534654271.jpg)
সত্যিকারের প্রতিভাবান শিল্পী রাজনৈতিক চেতনাবিবর্জিত হতে পারে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে চেতনা প্রগতিশীল হতে পারে আবার প্রতিক্রিয়াশীলও (যেমন : এজরা পাউন্ড)—কিন্তু কোনোক্রমেই নির্বিকার নয়। তাই দেখি, এ দেশের সাহিত্য বা চলচ্চিত্রক্ষেত্রে জহির রায়হানের চমকপ্রদ সাফল্যের মূলে ছিল তার গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবজ্ঞান এবং সমাজচেতনা।
জহির রায়হানের রাজনৈতিক জীবন এবং শিল্পীজীবনের সূচনা প্রায় একই সময়ে। অগ্রজ প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের উৎসাহে প্রায় স্কুলজীবন থেকেই জহির কমিউনিস্ট পার্টির কর্মপ্রণালিতে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং প্রথম দলের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে।
জহিরের প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘সূর্য গ্রহণ’ থেকে শেষ পর্যন্ত সকল সাহিত্যকর্মই ইউনিভার্সাল হিউম্যানিজমে উদ্বুদ্ধ এবং সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমে সম্পৃক্ত। শিল্পীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সে ছিল সদা সচেতন। সে বিশ্বাস করত যে শিল্পীর মহান দায়িত্ব হলো আপামর জনসাধারণকে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, যাতে করে একদিন সত্যিকারের ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠের সত্যিকারের প্রতিনিধিদের হাতে আসতে পারে বিপ্লবের মাধ্যমে। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই জহির এসেছিল চলচ্চিত্রাঙ্গনে। ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১) এরই ফলশ্রুতি এবং একই চেতনার আরো বলিষ্ঠ চলচ্চিত্ররূপ আমরা নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ করতাম ওর অসমাপ্ত ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ (১৯৭০-৭১) ছবিতে।
এমন একটি চেতনার শিখা যে মুনাফালোভী প্রযোজক-পরিবেশকদের চাপে নিভে যায়নি, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হলো স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জহিরের সক্রিয় ভূমিকা। পঁচিশে মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু হলো বাংলার বুকে বিদেশি দানবের তাণ্ডবনৃত্য। কিন্তু বহু পরিচিত শিল্পী-সাহিত্যিকের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় ভুগতে হয়নি জহিরকে। সে জানত, পরিবর্তিত অবস্থায় তার কর্তব্য কী।
যে মুষ্টিমেয় শিল্পী-সাহিত্যিক স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন কামরুল হাসান, জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমাম ও অন্যান্য কয়েকজন। দুর্ভাগ্যবশত অস্থায়ী সরকারের কোনো কোনো মহলের কাছে জহিরের রাজনৈতিক রং উপাদেয় ছিল না। ফলে মাঝেমধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে জহিরের অংশগ্রহণের অদম্য উৎসাহকে রীতিমতো বাধা প্রদান করা হতো। বলা বাহুল্য, জহিরকে নিরস্ত করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। সে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিল আত্মিক তাগিদে। কোনো পুরস্কার বা বড় চাকরি বাগাবার জন্য নয়, ফ্লুকে নেতা হয়ে টু-পাইস কামাবার জন্যও নয়। সে জানত দেশকে ভালোবাসা এবং তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা তার জন্মগত এবং আদর্শগত [কর্তব্য]।
তাই আমরা জহিরকে দেখেছি এক বহুমুখী ভূমিকায়। এবেলা সে পাক-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওবেলা দেখতাম সাংস্কৃতিক দলের অনুশীলনে স্ক্রিপ্ট পুনর্বিন্যাস করছে। যখন কিছু কিছু লোককে দেখেছি নিজেদের ফিল্মের প্রিন্ট বিক্রি করে আর্থিক সচ্ছলতা বাগাতে সচেষ্ট, ঠিক তখনই জহিরকে দেখেছি তার ‘জীবন থেকে নেয়া’র (১৯৭০) ভারতে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দান করতে—স্বীয় অর্থকষ্ট থাকা সত্ত্বেও।
ঘরে স্ত্রী সুচন্দা জ্বরে অজ্ঞান। বড় ছেলে অপুও অসুস্থ। জহির ঘরে নেই, স্টুডিওতে। দিন নেই, রাত নেই, ঘুম নেই—‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) তৈরি করছে। ও জানত বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচারই যথেষ্ট নয়, বিশ্বের সব পরাধীন শোষিত মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের একাত্মতা বোঝাতে হবে এই ছবির মাধ্যমে।
যা বলছিলাম, উপলব্ধির এই গভীরতা কোনো শিল্পীর পক্ষে সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিশেষ করে প্রয়োজন একটি মহৎ নির্ভেজাল আত্মার, নিয়মানুবর্তিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি মনের, পরশ্রীকাতরতায় পরম অনীহার এবং অসামান্য প্রতিভার। এর সবকটির পূর্ণ সমন্বয় ঘটেছিল জহিরের মাঝে।
আবার বলছি : উন্নত মানুষ জহিরই সৃষ্টি করেছিল শিল্পী জহিরকে।
[১৯৮১]
(১৯ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের জন্মবার্ষিকী। জহির রায়হানের তিরোধানের নবম বার্ষিকীর প্রাক্কালে সহযোদ্ধা আলমগীর কবির লিখিত এই রচনাটি নেওয়া হয়েছে আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল সম্পাদিত ‘চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি’ গ্রন্থ থেকে (পৃ. ১৫০-১৫২)। আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহের প্রথম এই খণ্ড ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যৌথভাবে প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী এবং মধুপোক।)