স্মরণ
উৎপলকুমার বসু : অনুপস্থিতিই যাঁর উপস্থিতি
‘আমার লেখায় আপনি দেখবেন যে কনটেন্ট-সচেতনতার চেয়ে ফর্ম-সচেতনতাটা বেশি। আমি ফর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। সেটা হয়তো এ কারণেই যে লেখায় আমি কনটেন্ট-এর দিক থেকে আসিনি, এসেছি ফর্মের দিক থেকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা লেখাকে আমি ভিসুয়ালাইজ করতে পারি যে পাতায় কেমন দেখাবে, ছাপায় কেমন দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নিজের পক্ষে লেখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।’ কথাগুলো থেকে উৎপলকুমার বসুর মেজাজটা বোধ করি চট করে ধরা যায়। ১৮ জুন ১৯৯৪ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর বলা এই কথার সঙ্গে পরে দেবেশ রায়ের কিছু কথার মিল দেখা যায়। দেবেশ রায়ও মনে করেন যে, কোনো লেখার জন্য, ‘ফ্রেম পাওয়াটাই তো আসল। ফ্রেম পাওয়া গেলে আর লিখতে কতক্ষণ?’ বা যখন বলেন, ‘হয়তো নির্ভুল সীমানা ছকার একটা নেশা আছে বলেই গল্প-উপন্যাস আমি লিখি।...এই নিশানা গড়ার, এই ফ্রেম করার একটা নেশা আছে। সেই নেশার একটা টান আছে। অমন নেশার টান না থাকলে এখন এই বয়সে বানিয়ে-বানিয়ে কে আর গল্প-উপন্যাস লিখতে যায়?’ ফলে আমাদের মনে হতে পারে বাঙালি পাঠক যখন বিষয়ের থেকে আঙ্গিকের দিকে ক্রমে মনোযোগী হয়ে উঠছে, সেই সময়ের কবি-লেখক হয়ে উঠছিলেন উৎপলকুমার বসু ও দেবেশ রায়ের মতো ব্যক্তিরা।
আরো একটা বিষয় বলতে হয়, যত আগে থেকে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বা কলকাতার কবি হিসেবে শঙ্খ-সুনীল-শক্তির নাম জানি, উৎপলকুমার বসু তাঁদের তুলনায় একটু পরে। আমার তো মনে হয় বিনয় মজুমদার আর উৎপলকুমার বসু দুজনেই পরে বাংলাদেশের কবিতার পাঠকদের কাছে পৌঁছেছেন। যদিও পৌঁছানোর পর পরই বোদ্ধা পাঠকদের বড় অংশই এই দুজনকে অনেক নিবিড়ভাবে গ্রহণ করেছিল। এ জন্য আশি ও নব্বই দশকের বাংলাদেশের কবিতা-চর্চাকারীদের ওপর এ দুজনের প্রভাব অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি বলেই মনে হয়। ওই সময় থেকে গদ্যে কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ এবং কবিতায় বিনয় ও উৎপল বাংলাদেশের সিরিয়াস সাহিত্যচর্চাকারীদের দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠেন। তবে এসব অনুকরণে (সেই বঙ্কিমের ভাষায়) দোষগুলোই অনুকৃত হয়েছে, গুণগুলো নয়। এঁরা কাউকে কাউকে এতটাই প্রভাবিত করেছেন যে তাঁরা তাঁদের নিজস্বতা পর্যন্ত হারিয়েছেন। তবে সে আলাপ এখানে নয়। আমার এঁদের প্রতি আকর্ষণের কারণটা অনুমানের চেষ্টা করি।
সবচেয়ে বড় কারণ মনে হয় গৎবাঁধা ও একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তির সন্ধান। নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে, নতুন ভাষায় সাহিত্যকে খুঁজে পাওয়ার সেই ইচ্ছা থেকে মনে হয় উৎপলকুমার বসুর ওপর আগ্রহটা বেড়ে চলেছিল। উৎপল একেবারে সরাসরি আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঠককে নিয়ে যান অস্বস্তিকর একটার পর একটা আবহে। কবিতার আড়ালে থাকা ‘না-লেখা কবিতাটি’ বা টেক্সটটি উৎপলের কবিতা যেভাবে খুঁজতে হয়, সেখানে পাঠকের একটা সচেতন প্রয়াস লাগে। তৈরি পাঠক না হলে উৎপলের কবিতায় ঢোকা মুশকিল। কিন্তু পাঠক যদি তৈরি হয়ে থাকে, বোদ্ধা পাঠক বলে যাদের বলি, তাদের জন্য উৎপলের কবিতার প্রতিটি অন্ধিসন্ধি রীতিমতো শিহরণজাগানিয়া। এটা ওই কমলকুমার মজুমদারের গল্প-উপন্যাস পড়ার মতোই প্রথম প্রথম অপ্রবেশ্য, দুর্বোধ্য, কিন্তু বারবার পড়ার পর ঠিকই এর ভেতরে প্রবেশ করা যায়, আর একবার যদি প্রবেশ করা যায়, সে হয় পাঠকের জন্য এক রোমাঞ্চকর সাহিত্য-অভিজ্ঞতা।
উৎপলের কাব্য-সংগ্রহের ‘ভূমিকা’ কবিতাটায় দেখুন
“পাবে আমাকেও। বাদার জঙ্গলে
এক পোর্তুগিজ অশ্বতর তোমাকে দেখাবে
আমি ও হেঁতাল কাঁটা ও-পশুর মাংসে বিঁধে আছি।
লৌহকণার গান শুনে যাও। শ্বেতকণিকার ক্ষিপ্ত নৃশংসতা শোনো।
বিষণ্ণ যার চোখ নেই, বৃদ্ধি আছে, খসে-পড়া আছে,
নেই ত্বক, শুধু ঝুলন্ত প্রদর আছে, পুঁজ আছে,
এঁকে নমস্কার করো।”
এভাবেই তিনি আমন্ত্রণ জানান। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, কবিতা সবার কাছে যেতে চায়, কিন্তু সবাই কবিতার কাছে আসতে পারে না। উৎপলকুমার মনে হয় সেখানে বললে বলতে পারতেন, কবিতাও সবার কাছে যেতে চায় না। জীবনানন্দের মতে, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। উৎপলের কবিতার সূত্রে বলতে হয়, সবাই তাঁর পাঠক নন, কেউ কেউ তাঁর পাঠক।
১৯৩৭ সালে কলকাতার ভবানীপুরে জন্মানো এই কবির পৈতৃক ভিটা মালখাননগর, মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুর, বাংলাদেশে। বাবার নাম প্রফুল্লকুমার বসু, মায়ের নাম সন্তোষিণী বসু। বহরমপুরে, কলকাতায় ও দিনহাটায় প্রথমদিককার পড়ালেখার শুরু। দীর্ঘ সময় বিদেশে ছিলেন, প্রথমে প্যারিস, পরে লন্ডন। সেখানে শিক্ষকতা ও নানা রকমের রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লন্ডনে ইন্ডিয়ান ওয়ার্কারস অ্যাসোসিয়েশন-এর তিনি ছিলেন লন্ডন শাখার সেক্রেটারি। বিদেশে গিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে, ফিরে আসেন ১৯৭৮ সালে। ওই বারো বছর বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে জানা যায়। ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের নানা জায়গায়ও। স্ত্রীর নাম সান্ত্বনা বসু ও ছেলের নাম ফিরোজ বসু। জিওলজিস্ট হলেও অনেকটা সময় ধরে জীবিকা ছিল শিক্ষকতা ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা। কবিতা চর্চায় তাঁকে হাংরি আন্দোলন ও কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, হাংরি আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে জীবনের শুরুর দিকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
তাঁর কবিতার বইগুলোর মধ্যে আছে ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ (১৯৬১), ‘পুরী সিরিজ’ (১৯৬৪), ‘আবার পুরী সিরিজ’ (১৯৭৮), ‘লোচনদাস কারিগর’ (১৯৮২), ‘খ-বৈচিত্র্যের দিন (১৯৮৬), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ( ১৯৯১), ‘সলমা-জরির কাজ’ (১৯৯৫), ‘কবিতাসংগ্রহ’ (১৯৯৬), ‘কহবতীর নাচ’ (১৯৯৭), ‘নাইট স্কুল’ (১৯৯৯), ‘টুসু আমার চিন্তামণি (২০০০), ‘মীনযুদ্ধ’ (২০০১), ‘প্রেমের কবিতা’ (২০০২), ‘নতুন কবিতা’ (২০০২), ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’ (২০০৪), ‘তীর্থ ও উদ্যান’ (২০০৬), ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ (২০০৬)। তাঁর গদ্যগ্রন্থ : ‘নরখাদক’ (১৯৭০), ‘ধূসর আতাগাছ’ (১৯৯৪), ‘উৎপলকুমার বসুর গল্প’ (১৯৯৮), ‘গদ্যসমগ্র’(২০০৫)।
উৎকুমার বসুকে বোঝার জন্য তো তাঁর বইপত্র পড়াই যথেষ্ট। এ ছাড়া কলকাতার ‘যোগসূত্র’ নামের একটি ছোটকাগজ তাঁকে নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র করেছিল, সেখানে তাঁর সম্পর্কে থাকা কয়েকটি লেখা ও একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার থেকে তাঁর মনোভঙ্গি অনেকটা বোঝা যায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘লোক’ পত্রিকাটিও এর একটি সংখ্যায় উৎপলকুমার বসুকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বাংলা কবিতায় তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে আসলে তরুণতর কবিদের বিশ্লেষণেই আমরা তাঁর গুরুত্ব বুঝতে পারি।
শিল্পী যোগেন চৌধুরীর মতে, উৎপলের কবিতায়, ‘প্রথম দিকটায় হয়তো জীবনানন্দের সঙ্গে সামান্য সুরের মিল ছিল, পরে যা একেবারেই অনুপস্থিত। শিল্পের উৎকর্ষ পরিমাণ দিয়ে বোঝানো যায় না, গুণগত বিচারেই তা উপলব্ধি করতে পারি আমরা। শ্রেষ্ঠচিত্রকর সাদা কাগজে আঁকেন একটি রেখা যা স্পন্দিত হতে থাকে। শ্রেষ্ঠ কবির রচিত একটি পঙক্তিও তেমন স্পন্দন সৃষ্টি করে থাকে। জীবনানন্দের কবিতা পাঠে যেমন অভিজ্ঞতা আমাদের হয়। এই সব মহৎ বৈশিষ্ট্যগুলো উৎপলের কবিতায়ও আছে। ওর ভেতরে সেই সম্পূর্ণ কবি আছে। পিকাসো যেমন যা ধরতেন, তাই সোনা হয়ে যেত। এ গুণ অনেকে পরিশ্রম করে অর্জন করে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন যাঁরা আপাদমস্তক শিল্পী। জীবনানন্দ-বিনয়-উৎপল এঁরা সেই জাতের।’
উৎপল অত্যন্ত সচেতনভাবে কবিতায় দেশি ও বিদেশি শিল্প-মতবাদের প্রয়োগ করছেন। সেই সঙ্গে অপ্রচলিত শব্দের যুৎসই ব্যবহারে তাঁর কবিতায় প্রায়শই বিদ্যুৎ খেলে যায়। (এখানে একটু আগে উদ্ধৃত ‘ভূমিকা’ নামের কবিতাটিতে ‘অশ্বতর’, ‘প্রদর’ শব্দ দুটো খেয়াল করুন পাঠক।) বাংলা কবিতার নতুন ভূগোল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, নতুন বিভ্রমের সৃষ্টি করে কবিতাকেই নানা বিভ্রম থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন- এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। ভুলে যাননি প্রেমের কথাও। কবি, কিন্তু প্রেমহীন এটা হয়ই না প্রায়। কবির ঘৃণাও প্রবল প্রেমেরই প্রকাশ। তাঁর রাগ বিদ্রোহ-বিদ্যুৎ সবই আসলে অনুরাগ, প্রেম, স্থির-আলো হয়ে জ্বলে ওঠে।
উৎপলকুমার বসু নিজেকে অস্বীকারের একটা আবহও তৈরি করতে চান। অনুপস্থিতির ভেতরে দিয়ে নিজেকে উপস্থিত করতে তিনি আগ্রহী। নইলে তিনি কেন অনুমোদন করেন তাঁর কবিতা সংগ্রহের ফ্ল্যাপে লেখা এই কথাগুলো ‘উৎপলকুমার বসুর কবিতা কতদিন নতুন থাকবে? বেশিদিন নয় নিশ্চয়ই। বারবার পাঠে ও প্রচারে, প্রশংসা ও নিন্দায়, অবজ্ঞায় ও ভালোবাসায় এর জীর্ণদশা আমরা অচিরেই দেখতে পাব। একদিন এসব লেখা, টুকরো টুকরে হয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ধুলোবালিতে মিশে যাবে।... আসুন, ততদিন এদের আমরা অল্প অল্প করে পড়ি। যেকোনো পাতা খুলে চোখ বুলিয়ে নিই। থেমে যাই। বইটা বন্ধ করি। সরিয়ে রাখি। মনে হবে কেউ কি দরজায় ডাকল। অনেকদিন পুরোনো বন্ধুদের খবর নেওয়া হয়নি কেন? নতুনদের নাম-ঠিকানা লেখা খাতাটাই বা কোথায় ফেলে এলাম।’ এই যে একটা দ্বন্দ্বিক-টান, সেটানেই তাঁর কবিতা আমাদের টানে। একদা তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় এসব লেখার দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে রাজি নই। আমি প্রতিশ্রুত নই লেখার জন্য। আমার লেখা শেষ পর্যন্ত সেই-সব ঠকবাজ পড়বে যারা হেঁসেলে মদের বোতল লুকিয়ে রাখে। যমুনাতীরে কামানের ছায়ার নিচে বসে আমি হাঁস ও শকুনের মাংস- খাওয়াব একদিন। সভ্যতা কি ততদূর বিস্তৃত হয়ে পড়বে? কিন্তু আমি ভীত নই। তাঁরাই ধন্য, যাঁরা নিজ সাহিত্যকে নিখুঁত বলে জানেন।’ এক গভীর ও তীক্ষ্ণ ঠাট্টার মতো বেজে ওঠে তাঁর এই সব কথা। নিজেকে অস্বীকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার কথাই তো এসব? তাঁর প্রজন্মের কবিদের ভেতরে, যাদের আমরা দশক বিচারে পঞ্চাশের কবি বলি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শহীদ কাদরী তাঁদের ভেতরে উৎপল নিজ বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতা পড়তে গেলেই একটা প্রখর সৃষ্টিশীলতার বোধ তৈরি হয়। জীবনের নানা প্ররোচণা আছে। আছে নানা উসকানি।
৩ অক্টোবর ২০১৫ শনিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে কবিতা ও গদ্যে নিজেকে রেখে চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। তাঁর অনুপস্থিতি থেকেই তীব্র হয়ে উঠতে থাকবে বাংলা কবিতায় তাঁর উপস্থিতি এই আভাস পাওয়া যাচ্ছে, অন্তত এখন অব্দি তো বটেই। কেউ কেউ মনে করেন, ইউরোপে যে কবিরা মরে গেছেন, তাঁদের ভূত নিজের কাঁধে চাপিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন উৎপল। এবার উৎপল তাঁর নিজের মৃত্যুর ভেতরে দিয়ে যদি বিপুলভাবে ফিরে আসেন, তাহলে প্রমাণ হবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ধুলোবালির মতো মিশে যাওয়া কবি তিনি ছিলেন না। তবে সে কথা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। আমরা কেবল বলতে পারি, উৎপলকুমার বসু এখনো জীবন্ত কবি। মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি।