জাতীয় জাদুঘরে ‘নভেরা প্রদর্শনী’
বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদের প্রথম জীবনের ৪০টি ভাস্কর্য বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে আছে। এই সংগ্রহের মধ্যে ৩৪টি ভাস্কর্য এবং পরে ফ্রান্সে অবস্থানকালে নভেরা আহমেদের আঁকা ২৮টি চিত্রকর্মের আলোকচিত্র নিয়ে প্রয়াত এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।
গত ৭ অক্টোবর বিকেল ৬টায় জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতির ইতিহাসে ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ নভেরা আহমেদ দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।’
সংস্কৃতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘১৯৫২ সালে মহান ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা প্রস্তুত করে শিল্পী নভেরা আহমেদ দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।’
বিশেষ অতিথির ভাষণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ‘এই মহান শিল্পী নভেরা আহমেদ বিগত ষাটের দশকে বাংলাদেশে প্রাপ্ত সহজলভ্য মাধ্যম ব্যবহার করে এ দেশের মা, মাটি ও মানুষের আদলে ভাস্কর্য তৈরি করে প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ দীর্ঘদিন নীরবে-নিভৃতে থাকলেও বাংলাদেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে কখনো ভোলেননি; বরং তাঁর শিল্পকর্মে তা অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৯৯৮ সালে প্রথম এবং ২০১৫ সালে দ্বিতীয় প্রদর্শনীর আয়োজন করে শিল্পীর প্রতি জাতীয় জাদুঘর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করল।’
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লালারুখ সেলিম। তিনি বলেন, ‘ভাস্কর নভেরাকে জানতে হলে তাঁর সৃষ্টি করা শিল্পকর্ম ও তাঁর সম্পর্কে গবেষণা ও প্রকাশনা করতে হবে। ভাস্কর নভেরার ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম পাঠ-পঠনে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করলে জাতি তাঁর সম্পর্কে জানতে পারবে।’
১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ ভাস্কর নভেরা আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কৈশোর ও যৌবন কেটেছে কলকাতা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া লন্ডনে। এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বসেরা ভাস্করদের শিল্পকর্ম দেখার নেশায়। তাঁর ভাস্কর্যরীতিকে ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিজম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, আদিম ভারতীয় শিল্পের সরলতার সঙ্গে ইউরোপীয় শিল্পকলার মসৃণতার মিশ্রণ তাঁর ভাস্কর্যরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিষয় নির্বাচন ও টেকনিকের বিবেচনায় তাঁর শিল্পকর্মে বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরি ম্যুরের প্রভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে তাঁর নির্মাণকলায় এক অদম্য, দুর্বিনীত, নির্ভীক শিল্পীর চেতনাধারা অন্তর্লীন হয়ে আছে।
১৯৭৩ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে; কিন্তু তিনি পুরস্কার নিতে দেশে ফেরেননি। ২০১৫ সালের ৬ মে ফ্রান্সেই মারা যান বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং শুক্রবার ২টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ পর্যন্ত দর্শকের জন্য প্রদর্শনীটি উন্মুক্ত থাকবে।