সুচিত্রা সেন ও মাধবী মুখোপাধ্যায় : বিশেষ যুগের প্রতিনিধি
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/04/06/photo-1428302689.jpg)
(বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মদিন আজ। ১৯৩১ সালের এই দিনে, ৬ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন চলে গেল গত ১০ মার্চ। তাঁদের দুজনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে রচিত হয়েছে এই প্রবন্ধ।)
বিশেষ যুগে এমন বিশেষ কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে সেই যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশেষ যুগের কথা মনে পড়ে যায়। শিল্পমাধ্যমের অন্যান্য শাখার চেয়ে চলচ্চিত্রে এ বিষয়টি মোটাদাগে পরিলক্ষিত হয়। কেননা, চলচ্চিত্র শ্রবণ ও দর্শনের কাজটিই শুধু করে না, সে সঙ্গে যুগের পর যুগ ধরে ধারণ করে রাখার কাজটিও করে। মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রেও আমরা বিশেষ যুগে বিশেষ বিশেষ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাই, যাঁরা সেই যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ায়, যেমন—স্তানিস্লাভস্কি, ভারতের কলকাতায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শম্ভুমিত্র, শাওলি মিত্র, উৎপল দত্ত, বাংলাদেশে আবদুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসী মজুমদার প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকে একটা বিশেষ যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু মঞ্চের সঙ্গে চলচ্চিত্রের পার্থক্য হলো, চলচ্চিত্রে যা ধারণ করে রাখা যায়, মঞ্চে তা সম্ভব হয় না। চার্লি চ্যাপলিনের ছবি ইচ্ছা করলেই এখনো আমরা দেখতে পারি, কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষ বা আবদুল্লাহ আল মামুনের মঞ্চনাটকগুলো ইচ্ছা করলেই আমরা এখন দেখতে পাব না। অন্যদিকে, আমাদের চলচ্চিত্রে আমরা পাই কবরী, রাজ্জাক, ববিতা, শাবানা, আলমগীর, প্রবীর মিত্র প্রমুখ। তাঁরাও একটা বিশেষ যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ভারতের সুচিত্রা সেন (৬ এপ্রিল, ১৯৩১—১৭ জানুয়ারি, ২০১৪) এবং মাধবী মুখোপাধ্যায় (১০ মার্চ ১৯৪৩— ) তেমনই দুজন চলচ্চিত্রশিল্পী। দুজনের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের কথা মনে পড়ে যায়। বাংলা চলচ্চিত্র যখন সবে বিকশিত হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই তাঁদের আগমন ঘটে। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, এই যে বিশেষ সময়ের কথা আমরা বলছি, সেই সময়টার প্রতিনিধিত্বের জন্য যে স্থান বা স্পেসের প্রয়োজনীয়তা থাকে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। এই দুজন শিল্পীর যখন চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে, তখন সেই শূন্য জায়গা ভরাট করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে স্থান বা স্পেস তাদের সামনে খোলা ছিল। কেননা, চলচ্চিত্র তখন অন্যান্য শিল্পশাখার সর্বকনিষ্ঠ শাখা হিসেবে মাত্র চলতে শুরু করেছে, যদিও সেই চলার পথটা অত মসৃণ ছিল না, কিন্তু ছবিতে অভিনেত্রীদের আগমনও অত সহজ ছিল না। সিনেমায় মেয়েদের অভিনয় করা সমাজ তখনো ভালো দৃষ্টিতে দেখত না। তাই তাঁরা যখন আসেন, তখন ছবিতে নিজেদের স্থান করে নিতে তাঁদের তেমনভাবে বেগ পেতে হয়নি। বিশেষ করে সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, তাঁর শ্বশুর আদিনাথ সেনের পূর্ণ সমর্থন এবং স্বামী দিবানাথ সেনের সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা চলচ্চিত্রে স্থান করে দিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছিল। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে, সেদিন যদি তাঁরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য এগিয়ে না আসতেন, আমরা এমন প্রতিভাবান শিল্পীর কাজ থেকে শুধু বঞ্চিতই হতাম না, চলচ্চিত্রে পরবর্তী প্রজন্মের আগমন ঘটতে হয়তো আরো কিছুটা দেরি হতো।
সুচিত্রা সেনের জন্ম (প্রকৃত নাম রমা দাশগুপ্ত ) এবং বিদ্যালয় পাঠ সমাপ্ত পাবনার বেলকুচিয়ায় হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় স্কুলমাস্টার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত এবং মা ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে কলকাতা চলে আসেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনি। সম্ভবত সেখান থেকে কিছুটা শিল্পসত্তা তাঁর ভেতর আগে থেকেই লুপ্ত অবস্থায় ছিল, যা পরে চলচ্চিত্রে আগমনের সঙ্গে বিকশিত হয়। অন্যদিকে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়। একেবারে ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে মাধবী অভিনয় করে আসছিলেন। অর্থাৎ তাঁর অভিনয় জীবন শৈশব থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে তপন সিংয়ের ‘টনসিল’ ছবির মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে ভাবতে বেশ অবাক লাগে, সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি ১৯৫২ সালে নির্মিত ‘শেষ কোথায়’ মুক্তির মুখ কখনো দেখেনি। ‘শেষ কোথায়’ মুক্তি না পেলেও ওই একই সময়ে নির্মিত এবং উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ কমেডি ছবির সাফল্য চলচ্চিত্রজগতে তাঁকে শুধু প্রতিষ্ঠিতই করেনি, একই সঙ্গে উত্তম-সুচিত্রা জুটি হিসেবে চিরস্থায়ী করে দেয়। সে সময়ে, অর্থাৎ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কোনো ছবি উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া কেউ কল্পনাও করতে পারত না। এমনি ছিল সেই জুটি। সে সময়ে একটা গল্প প্রচলিত ছিল এ রকম, উত্তম-সুচিত্রার ছবি মানেই শুধু বক্স অফিস হিট নয়, একই সঙ্গে তা মিলনাত্মক। একবার একটা ছবি হলে চলার সময় (নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত) দেখা গেল, শেষ দৃশ্যে উত্তম-সুচিত্রার মিলন হয়নি। হলে দর্শকের চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। দর্শক কিছুতেই তাঁদের মিলন না দেখে হল থেকে বের হবে না। শেষে অন্য আরেক ছবির মিলন দৃশ্যের রিল এনে সেটা জুড়ে দিয়ে হলের মালিক রক্ষা পেলেন।
অন্যদিকে, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এ রকম ধরাবাঁধা কোনো জুটি দেখা না গেলেও শুধু অভিনয় গুণে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০)-এর পর ১৯৬৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিটি তাঁকে দেশে ও বিদেশে পরিচিতি এনে দেয়। এর পর একে একে সুচিত্রা সেন ও মাধবী মুখ্যোপাধ্যায় প্রচুর ছবি করেন। দুজনই জনপ্রিয় এবং পুরস্কৃত হন প্রভূত পরিমাণে।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি সামাজিক অবস্থা নিয়ে এবার কিছুটা আলোচনা করা যাক। কেমন ছিল সেই সময়ের মানুষের জীবনযাপন, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি? আমরা যদি একটু আগে থেকে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, ১৯১৪ থেকে ১৯৪৭ সাল সময়টি ছিল সারা পৃথিবীর জন্য একটা ভাঙাগড়ার সময়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে জড়বাদী ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞান ধর্মের স্থান অধিকার করেছিল এবং মানুষের সমাজ ও তার মূল্যবোধকে একটা ঐক্যসূত্রে গেঁথেছিল, সেসব বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এসে বিভিন্ন নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা, গ্রহতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি মানুষের মানসজগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করল। রেনেসাঁর সময়ে যে মানুষ ছিল জগতের কেন্দ্রে, সেই মানুষ কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করল। রেডিও অ্যাক্টিভিটির মূল সূত্রগুলো প্রমাণের সঙ্গে প্রাকৃতিক জগতের কার্যকারণের অনিবার্যতা অমূলক হয়ে দেখা দিতে লাগল, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি ও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ আগের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো বদলে দিল, ডারউইনবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হলো, ধর্ম, মরমিবাদ ইত্যাদি আবার স্থান করে নিতে শুরু করল। চিন্তাজগতের এসব পরিবর্তন শিল্পজগতেও প্রভাব ফেলতে লাগল। তবে সঙ্গে সঙ্গে নয়, ধীরগতিতে।
বিশ্ব রাজনীতিতে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই আরেক যুদ্ধ শুরু হলো ইতিহাসে, যা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রবাদের মাঝে বিবাদ ক্রমে বেড়ে উঠল, সমাজতান্ত্রিক ব্লক দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলো খুবই ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্য দিয়ে চলা শুরু করল। তবে এ সময় যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বর্তমানের মতো এত জটিল আকার ধারণ করেনি। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রভাবে পুঁজিবাদ বর্তমানের মতো খুঁটি গেড়ে বসতে পারেনি তখনো। অর্থাৎ ‘ভোগবাদ’ নামে সংক্রামক ব্যাধিটি সেভাবে সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়নি। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোও তাই আকাশচুম্বী ছিল না। একরকম সহজ-সরল জীবনযাপনেই তারা ছিল সন্তুষ্ট এবং অভ্যস্ত। ফলে চলচ্চিত্রেও তার ছাপ থেকে যেত। গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র জীবন থেকে নিয়েই নির্মিত হয়, জীবনের বাইরে থেকে নয়। তবে এক ধরনের ভাবালুতার প্রবণতাও মানুষের মধ্যে ছিল।
ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক ধারার আন্দোলন শুরুর একশ বছর পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। শেলি, কিটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ রোমান্টিক কবিই বেশি পরিমাণে তাকে আকর্ষণ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে শিল্পের নানা শাখায়, বিশেষ করে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক ধরনের রোমান্টিক আবহ বিরাজ করতে সহায়তা করে। চলচ্চিত্রেও এই রোমান্টিসিজমের প্রভাব পড়ল, যা পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ছবিতে আমরা দেখতে পাই। তাই সে সময়ে অধিকাংশ বাণিজ্যিক যে ছবি নির্মিত হতো, সেগুলো বাস্তব জীবন থেকে কিছুটা দূরে অনেকটা রূপকথার মতোই মনে হতো। মধ্যবিত্ত জীবনের সাধারণ গল্প, প্রেম, ভালোবাসা, হাসি-কান্না নিয়েই কাহিনী নির্মিত হতো। যদিও সে সময়ে মানুষের জীবনের গতি ছিল কিছুটা স্লথ। তাই রোমান্টিক ধারার ছবির গতিও বেশ ধীরে চলতে দেখা যায়। সিনেমার আঙ্গিক বর্তমানের মতো দ্রুত কাটিংয়ে অভ্যস্ত হয়নি তখনো। সিনেমার এই ধীরগতিও সে সময়ের মানুষকে বুঝতে আমাদের অনেক সহায়তা করে।
অন্যদিকে, পঞ্চাশের দশক থেকে ভারতে যখন বাণিজ্যিক ছবির বিস্ফোরণ ঘটছিল, তার কিছু আগে থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইতালির নিও-রিয়ালিজম ধারা এবং ফরাসি নিউওয়েভ বা নবতরঙ্গের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কলকাতার চলচ্চিত্রে নিউওয়েভ সেভাবে সাড়া না জাগালেও নিও-রিয়ালিজম ধারার প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আগ্রহ ক্রমে বাড়তে থাকে। তার একটা ঐতিহাসিক কারণ অবশ্য আছে। পশ্চিমের নিও-রিয়ালিজমের একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল, যা বড় দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি থেকে গড়ে উঠছিল। ভিত্তিটা কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো যখন ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিল না, সামাজিক অব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সেসব দেশে এক ধরনের বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। যার ফলস্বরূপ নিও-রিয়ালিজম। একইভাবে আমরা দেখতে পাই, ভারতের স্বাধীনতাও তখন, অর্থাৎ ষাটের দশকে প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ যাকে বলে, সবার কাছে তখনো পৌঁছাতে পারেনি। সামাজিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদি ক্রমে সবাইকে অসন্তুষ্ট এবং বিদ্রোহী করে তুলছে। তাই জীবন ঠিক যেমন ঠিক সেভাবে জীবনকে উপস্থাপন করার যে নিও-রিয়ালিজম প্রবণতা, তার দ্বারা এখানকার চলচ্চিত্র নির্মাতারাও প্রভাবিত হলেন, যেমন–সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংয়ের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা। এভাবে নিও-রিয়ালিজম ও রোমান্টিসিজম এবং বাস্তব-অবাস্তব মিলিয়ে সাদা-কালোয় নির্মিত সেসব ছবি, রুপালি পর্দায় যেন রঙিন হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছিল। তবে রোমান্টিসিজম বা নিও-রিয়ালিজম যেকোনো ধারারই ছবি হোক না কেন, সিনেমা যেহেতু সিনেমা, পুরোপুরি বাস্তব নয়, তাই সেসব সিনেমায় আমরা চরম বাস্তবতাকে না পেলেও বাস্তবের কাছাকাছি কাহিনী পাই। সিনেমার এই বাস্তব-অবাস্তবতার মতো সুচিত্রা ও মাধবী অভিনীত চরিত্রের মাঝেও কিছু কিছু পার্থক্য আমাদের চোখে ধরা দেয়।
প্রথমে দেখা যাক, সুচিত্রা সেনকে কোন ধরনের ছবিতে বেশি দেখা যেত? মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতেই তাঁকে আমরা বেশি করে দেখতে পাই। যেখানে নায়ক-নায়িকার প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ-মিলন নিয়ে গড়ে ওঠে কাহিনী। নায়ক-নায়িকার আনন্দ আর বিরহে দর্শকও আনন্দ ও বিরহের আবেগে যেন আপ্লুত হয়ে পড়ত সেই সময়ে। এই যে ভাবাবেগে আপ্লুত হওয়ার কথা আমরা বলছি, সেটা কিন্তু এখনকার দর্শকের মাঝে সেই মাত্রায় পাওয়া যাবে না। কারণ, সেই সময়ের দর্শক এখনকার দর্শকের মতো এত হিসাবি হয়ে ওঠেনি। হিন্দি সিরিয়ালের জটিলতা, কুটিলতা নয়, সহজ-সরল ছিল তাঁদের চিন্তাপ্রবাহ। তাই ‘হারানো সুর’ ছবিতে সুচিত্রাকে আমরা দেখি, কী নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর স্মৃতিভ্রষ্ট স্বামীকে (উত্তম কুমার) ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেন। ‘তুমি যে আমার’ গানটি শুধু সুচিত্রার কারণেই যেন আরো বেশি আবেগঘন হয়ে ওঠে। তবে আবেগের যথেচ্ছাচার নয়, যথোচিত। সুচিত্রা যখন তাঁর হারানো মানুষটাকে ফিরে পাওয়ার আশায় তাঁর জন্য সোয়েটার বোনে (ছবিতে প্রতীকী অর্থে যা দেখানো হয়), এ যেন এক আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে দর্শক এবং নায়িকার মনে। সুচিত্রার মতো অনেক মানুষ সে সময়ে দেখা যায়, যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত, কোনো নতুন কবির লেখা দু-একটা মিষ্টি কথায় তাদের মনটাকে ভরিয়ে রাখতে জানত। গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকিতে মন চমকে উঠত, দুলে উঠত। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির শেষ দৃশ্যের সুচিত্রা সেনকে যেন ভোলাই যায় না। প্রেমের অভিনয় করতে করতে কখন যে সত্যি সত্যি প্রেম তাঁকে ঘিরে ধরে, তা নিজেও যেন বুঝতে উঠতে পারেন না। অভিনয় করতে না পারার বিষয়টি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলা হয়েছে, সে সময়ের মানুষরা এক ধরনের সহজ-সরল জীবনে বিশ্বাসী ছিল। যেহেতু ভোগবাদ তখনো সেভাবে সংক্রমিত হয়নি, তাই তাদের জীবনে শঠতা নয়, সততা স্থান করে নিতে পেরেছিল খুব সহজে। সুচিত্রার বিশুদ্ধ সেই প্রেম শেষ পর্যন্ত তাঁকে তাঁরই মানসিক হাসপাতালের রোগীতে পরিণত করে। দর্শক আহত হন, কিন্তু একই সঙ্গে সততার সঙ্গে বেঁচে থাকার এই যে দৃঢ়তা সেদিনের সে সময়ের সমাজকেই যেন প্রতিফলিত করে। স্বল্প পরিসরের জন্য উদাহরণ সীমাবদ্ধ রাখা হলো। মোটকথা, সুচিত্রার চরিত্রগুলো যেন স্বপ্নে বোনা, আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা আর বনলতা সেনকে খুঁজে পাওয়ার আশায় হাজার বছর ধরে হেঁটে চলার এক অনন্তযাত্রা।
অন্যদিকে, মাধবী মুখোপাধ্যায় ছিলেন কিছুটা ভিন্ন ধারার সিরিয়াস ছবির নায়িকা। প্রেমের চেয়ে জীবন-সংগ্রাম যেখানে বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘মহানগর’-এর মাধবী নগর কলকাতার উঠতি মধ্যবিত্তের নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত এক নারী। এই নারী সেই সময়ের, যে সময়ে নারীরা পরিবারের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মাত্র ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে, জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের প্রয়োজনে। কিন্তু এই প্রয়োজন তাঁর ব্যক্তিত্বকে কলুষিত করে না। স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ার পর তাঁর ওপরেই সংসারের ভার এসে পড়ে। তার পরও আমরা দেখতে পাই, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এডিথের অপমানের প্রতিবাদস্বরূপ সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসে। তার একার ওপর নির্ভরশীল সংসারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও সে কাজটি করে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এডিথের অন্যায় সে নীরবে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু আশাও ছাড়ে না। মনে পড়ে শেষ দৃশ্যের মাধবীর মুখে শেষ সেই সংলাপ, ‘এত বড় কলকাতা শহর, এই শহরে দুজনের একজনেরও কি চাকরি হবে না?’ এখানেও দেখি পুঁজিবাদী ভোগবাদ তখনো মানুষের মনকে কলুষিত করেনি। সুকান্তের কলমের মতো বারবার তার ঘাড় আনত করে রাখতে চায় না। আবার ‘কাপুরুষ’ ছবির মাধবী যেন অন্য আরেক মানুষ। যে মানুষ হিপোক্রেসি জানে না, শঠতা তার চরিত্রকে স্পর্শ করে না। স্পষ্টবাদী মাধবী তাই তাঁর অস্পষ্ট প্রেমিক অমিতাভের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ওপর ভরসা রাখতে পারে না। চা বাগানের ম্যানেজারকে বিয়ে করে সংসার করে। পরিণত অভিজ্ঞ নারী কিসের ওপর ভিত্তি করে জীবনসঙ্গী বেছে নেয়, তার বাস্তব এক চিত্র যেন এই ‘কাপুরুষ’ ছবির মাধবী। নারী যদি শিক্ষিত হয়, অভিজ্ঞ হয়, তাহলে সে তার পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারে। কোনো নারীবাদী তত্ত্ব দিয়ে নয়, কাহিনীর বুনন দিয়ে ‘কাপুরুষ’-এর মাধবী নারী জাগরণের ইঙ্গিত দেন। যে সময়ে নারীরা সবে জাগতে শুরু করেছে, ঘরের চার দেয়ালের সীমানায় সে বন্দী থাকতে রাজি নয়।
মাধবীকে তাই মনে হয় আটপৌরে, প্রতিদিন দেখা একজন চেনা মানুষ। অন্যদিকে সুচিত্রা যেন পরিপাটি, গ্ল্যামারাস। দুজনের চেহারার গড়নও যেন অনেকটা সেই রকম। সুচিত্রা মানুষকে যত দ্রুত আকর্ষণ করে, মাধবী আকর্ষিত হন ধীরে। সুচিত্রা দর্শককে যত সহজে কাঁদায়-হাসায়, মাধবী মানুষকে ঠিক ততটাই যেন ভাবায়। এর পেছনে দুই ধারার চলচ্চিত্র প্রধানত প্রভাব বিস্তার করে। বাণিজ্যিক ছবির রোমান্টিসিজম তাই সুচিত্রাকে সহজেই আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে, নিও-রিয়ালিজমের মাধবী মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। জীবন ঠিক যেমন সেভাবে দেখিয়ে দেয়। একই পূর্ণিমার চাঁদ তাই মাধবীর জায়গায় হয়ে যায় ‘ঝলসানো রুটি’ আর সুচিত্রার জায়গায় হয়ে পড়ে ‘এই রাত তোমার আমার’। মাধবী বাস্তবকে করেন উন্মোচিত আর সুচিত্রা থাকেন বাস্তব থেকে কিছুটা দূরে। সুচিত্রাকে তাই রুপালি পর্দাতেই মানায় বেশি, মাধবীকে যেন পাই বাস্তবের মাটিতে। সুচিত্রাকে ভাবতে ভালো লাগে, কিন্তু কাছে যেতে শঙ্কা হয়। অন্যদিকে মাধবীকে ভাবতে অতটা ভালো না লাগলেও কাছে যাওয়ার সাহস জাগে। সুচিত্রাকে দেখে তাঁর মতো হতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে থাকে আকাশের ওপারের আকাশে, অধরা। এভাবেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে দুজনই সেদিন মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। সে সময়ের সমাজ-বাস্তবতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন দুজনই। আজকেও যখন কেউ তাঁদের ছবি দেখেন ইউটিউব অথবা ডিভিডিতে, একই রকম ভালো লাগা কাজ করে। ছবি দেখতে দেখতে মানুষ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে চলে যান নিজেদেরই অজান্তে। অন্যদিকে সুচিত্রা সেন ও মাধবী মুখোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন সে সময়ের প্রতিনিধি হয়ে। এখানেই দুজনের অভিনয়ের সাফল্য। ১০ মার্চ মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেনের জন্মদিন উপলক্ষে দুজনকে জানাই আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ফ্লোরা সরকার : অভিনয়শিল্পী ও লেখক।