‘কেউ ডাকেনি, তবুও এলাম, বলতে এলাম ভালবাসি’

ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।
অগ্ন্যুৎসব
দ্রোহের কবি হিসেবেই বেশি চিনি তাকে। তিনি ডেকেছেন যুবককে, শুনিয়েছেন যৌবনের গান, জানিয়েছেন সংসারের ইচ্ছের ধ্বনি, খুব ক্ষেপে গিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রকেই গালাগাল। তার লেখায় জেগেছে শব্দরা, গড়েছে শক্তিশালী প্রতিধ্বনী। তাইতো আজও আন্দোলন সংগ্রামে তারই পঙক্তি স্লোগান হয়ে ওঠে। ভাষণে ভাষণে ভাসে—‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...’। তিনি আর কেউ নন, অতি বরেণ্য, শ্রদ্ধেয় কবি হেলাল হাফিজ।
কবি হেলাল হাফিজের লেখা খুব অল্প সংখ্যক কবিতার মাঝে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো অজস্র পঙক্তি আলোচিত। তিনি মানবতার কবি বলেও পরিচিত। মানবতার ডাকে তিনি বলেছিলেন, ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না !’ আর তার জীবনজুড়ে তো ছুঁয়ে আছে প্রেম! সব মিলিয়ে তার কবিতা কখনও মিছিলের হাতিয়ার, কখনও প্রেমের নিবেদন, আবার কখনও মানুষের প্রতি নিঃশেষ আস্থার প্রকাশ। তিনি লিখেছেন কম, কিন্তু লিখেছেন এমনভাবে—যে প্রতিটি পঙক্তিই হয়ে উঠেছে একেকটি মন্ত্র; সময়ের ভাষা।
প্রেমময় দ্রোহের আগুন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন, তরুণ সমাজের প্রতিবাদী চেতনার প্রশ্ন হেলাল হাফিজের কবিতায় ধরা দিয়েছে এক বিস্ময়কর স্বচ্ছতায়। ‘অগ্ন্যুৎসব’ তার প্রেমময় দ্রোহের আগুন। এটি কোনো ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস নয়, বরং গভীর নৈতিক অবস্থান। সেখানে তিনি যুদ্ধ বা অস্ত্রের কথা নয়; প্রেম ও মুক্তির দ্বৈত প্রতীক ফুটিয়েছেন। লিখেছেন, ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে,/জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে...’
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর মতো কবিতার সেই শ্রেষ্ঠ পঙক্তি আজও মিছিলে-ভাষণে স্লোগান হয়ে বেঁচে আছে—‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...’
এই আহ্বান শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি এক অস্তিত্বের ডাক—যেখানে কবি তরুণ সমাজকে আহ্বান করছেন মানবতার পক্ষে, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে।
প্রেম ও যুদ্ধে সমান্তরাল জীবন ও ‘অন্যরকম সংসার’
‘অন্যরকম সংসার’ কবিতায় প্রেম ও যুদ্ধ একাকার হয়ে যায়। এখানে যুদ্ধ মানে কেবল রক্তপাত নয়—এটি প্রেমেরও রণক্ষেত্র। কবি লিখেছেন, ‘এই তো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো/আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো...’
এই কবিতায় ‘রানা’ কেবল ভালোবাসার মানুষ নন, তিনি কবির যুদ্ধসঙ্গী। তারা গোলাপ বাগান তৈরির স্বপ্ন দেখে, কিন্তু জানে—এই গোলাপের পাপড়িতে রক্তের দাগ থাকবে। মৃত্যুর মধ্যেও প্রজন্মকে জাগিয়ে রাখার আশা, ধ্বংসের ভেতরেই সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা—এতো কবি হেলাল হাফিজের স্বভাবসুলভ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ, যা তিনি ধারণ করেছেন, তা তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি লিখেছেন, ‘মাটির সাথে মিশে গিয়ে জৈবসারে গাছ বাড়াবো/ফুল ফোটাবো, গোলাপ গোলাপ স্বদেশ হবে...’
পতাকার প্রত্যাশা ও বাস্তবতার হতাশা
‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা’, পঙক্তিটি স্মরণ করিয়ে দেয়, ভালোবাসার আকাঙ্খার কথা, স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা। দোলাচলে দোলায়িত স্বাধীনতাকামী শব্দোচ্চারণ কবি হেলাল হাফিজের বৈশিষ্ট্য। তার মন কবিতায় নদীর মতো প্রবাহমান। চুপকথার রাজ্যে বিরচণ করে বাঁচতে চাননি কবি কখনোই। বাস্তবতার নির্মম সত্য তাই ফুটে উঠেছে বারবার তার কবিতায়।
হেলাল হাফিজ পতাকার নিচে অনাহার, অন্যায়, বৈষম্য দেখেছেন। সে সময়ের রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছেড়েছেন। মানবতার শপথ নিতেও পিছপা হননি কবি হেলাল হাফিজ। লিখেছেন কবিতার কসম খেলাম’ শিরোনামে কবিতায় লিখেছেন, ‘পাখি যদি না দেয় উড়াল, না পোড়ে আগুন,/অদ্ভুত বন্ধ্যা হলে উর্বরা ফাগুন, আমি আহত হবো না।’ যে কবিতার বাকিটা বলবো শেষে।
হেলাল হাফিজের কবিতা প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু তা কোনো সহিংসতার নয়; এটি কবিতার শপথ—যে কবিতা দিয়েই অন্যায়ের জবাব দেবে। এভাবেই হেলাল হাফিজ কবিতাকে অস্ত্র বানিয়েছেন, তবে সেই অস্ত্র রক্ত ঝরায় না—বরং বিবেক জাগায়। কবিতায় কবি রাজনীতির মঞ্চে প্রেমের রঙ ঢেলে দিয়ে বলেছেন—
‘ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এত আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো, স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।’
পতনের দর্শন ‘নিখুঁত স্ট্র্যাটেজী’
খুব ভালো করে স্ট্যাডি করলে কবিকে ‘নিখুঁত স্ট্রাটেজী’তে আনা সম্ভব। তার কবিতায় বহুমাত্রিক দর্শন কাজ করে—যেখানে প্রেম, দ্রোহ, মানবতা ও অস্তিত্বচেতনা একসূত্রে গাঁথা। সেখানে থাকে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে গভীর ভাবনার এক শিল্পিত ভাষ্য। তার দর্শনের মূল সুর মানবমুক্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। তার দৃষ্টিতে প্রেমও এক ধরনের প্রতিবাদ—যে প্রেমে আছে আত্মত্যাগ, আছে রক্তের মূল্য। এজন্যই তিনি লিখতে পেরেছেন, ‘জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে।’
হেলাল হাফিজ বিশ্বাস করেন, পতনই পুনর্জন্মের সূচনা। তিনি তাই বলেছেন, ‘পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো বলে।’ এখানে জীবনের ব্যর্থতা কোনো শেষ নয়, বরং তা নতুন সম্ভাবনার পথ। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এক অস্তিত্ববাদী কবিতে রূপ দিয়েছে। তার কবিতায় প্রেম কখনও ব্যক্তিগত, কখনও সামাজিক। ‘অন্যরকম সংসার’-এ প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে স্বদেশকে গোলাপে ভরিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। এই প্রেম আত্মকেন্দ্রিক নয়, বরং সৃষ্টিমুখী ও মানবমুখী।
হেলাল হাফিজের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ না বোঝা মানেই সভ্যতার পরাজয়। তাই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন—‘মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ/আমি আহত হবো না...’
সমাজ ও শ্রেণি-বাস্তবতার ভাষা ‘যার যেখানে জায়গা’ ও ‘ফেরীঅলা’
যৌবনকে বাজি ধরে জীবনের অসাধারণ স্কেচ এঁকেছিলাম’ বলে ঘোষণা দেওয়া কবি তীব্র ব্যঙ্গ শব্দে শব্দে গেঁথেছেন সমাজের নৈতিক অবক্ষয়। প্রয়োজনে সমাজকে গালাগাল দিতে ছাড়েননি। এর মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন সমাজের চোখ। হয়তো পেরেছেন, নয়তো পারেননি। ‘যার যেখানে জায়গা’ কবিতায় রাত্রির ভবনে গোপন লেনদেন, কানাঘুষো, আর ভণ্ডামির মুখোশ খুলেছেন তীক্ষ্ণ ভাষায়। গ্রামীণ ভাষার ব্যবহারে বলেছেন—‘রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি, আমিও গ্রামের পোলা চুত্মারানি গাইল দিতে জানি।’
আর শেষমেশ শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণার কষ্ট ফেরি করেছেন ‘ফেরীঅলা’-য়। বলেছেন— ‘কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে।’
ভাষা, কাব্যরীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি
হেলাল হাফিজের কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি তার সরল অথচ তীক্ষ্ণ ভাষা। তিনি কোনো আড়ম্বর বা দুর্বোধ্য রূপকের আশ্রয় নেন না। তার ভাষা কথ্য, তার ভাব সরাসরি। এই কারণেই তার কবিতা শুধু বইয়ে নয়, মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে। তিনি শহুরে বাস্তবতা ও গ্রামীণ রসবোধকে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন এক কাব্যভাষা, যেখানে আদর্শ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বই কবিতার প্রাণ। তার কবিতা যুগে যুগে তরুণদের দিয়েছে সাহস, প্রেমিকদের দিয়েছে ভাষা, আর রাষ্ট্রকে দেখিয়েছে আয়না। আজ যখন সমাজে হাহাকার, যখন মানবতা হুমকির মুখে, তখন হেলাল হাফিজের কণ্ঠ আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
‘মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ
আমি আহত হবো না... কিন্তু কবিতার কসম খেলাম,
শোধ নেবো সুদে ও আসলে।’
তারপরও আমরা আশাবাদী। কবির মতো বলতে চাই—
‘তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।’