‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজ যেভাবে শুরু

‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজটি বাংলাদেশের কিশোর সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে, যা শুধু একটি বইয়ের সিরিজ নয়, বরং পুরো একটি প্রজন্মের শৈশবের রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের প্রতীক। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই সিরিজটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে গোয়েন্দা কাহিনীর এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছিল, যেখানে তিনজন কিশোরের বুদ্ধি, সাহস আর মজাদার বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে রহস্যের জট খোলা হতো।
তবে এই কালজয়ী সিরিজের শুরুটা ছিল বেশ চমকপ্রদ। এটি সরাসরি মৌলিক রচনা ছিল না, বরং বিদেশী একটি তুমুল জনপ্রিয় সিরিজকে দেশীয় পটভূমিতে সার্থকভাবে উপস্থাপনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। লেখক রকিব হাসানের নিপুণ লেখনী এবং দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফলেই আমেরিকান গোয়েন্দা ত্রয়ী জুপিটার জোনস, পিট ক্রেনশ এবং বব অ্যান্ড্রুস রূপান্তরিত হয়েছিল বাঙালি কিশোর-কিশোরীদের প্রিয় কিশোর পাশা, মুসা আমান এবং রবিন মিলফোর্ডে।
১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা দ্রুতই কিশোরদের মধ্যে এক সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। রকিব হাসান বিদেশী গল্পের কাঠামো ধরে রেখেও চরিত্র ও পরিবেশের এমন এক দেশীয়করণ করেছিলেন যে, ক্যালিফোর্নিয়ার রকি বীচ যেন পাঠকের কাছে বাংলাদেশেরই কোনো পরিচিত শহরে পরিণত হয়েছিল। এই সিরিজ শুধু গোয়েন্দাগিরি শেখায়নি, শিখিয়েছে কঠিন পরিস্থিতিতেও বন্ধুত্ব, সাহস ও বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। এভাবেই 'তিন গোয়েন্দা' সিরিজের সূচনা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের পাতায়, যা আজও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।
বিদেশী উৎস ও দেশীয়করণের চিন্তা:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ 'তিন গোয়েন্দা'র মূল ভিত্তি হলো আমেরিকান লেখক রবার্ট আর্থার জুনিয়রের 'দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস' (The Three Investigators) সিরিজটি। এটি ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় এবং এর প্রধান চরিত্র ছিল জুপিটার জোনস, পিট ক্রেনশ ও বব অ্যান্ড্রুস। বাংলাদেশে এই সিরিজের সূচনা করার প্রধান কারিগর ছিলেন লেখক রকিব হাসান। তিনি সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনকে কিশোরদের উপযোগী একটি নতুন সিরিজ শুরু করার প্রস্তাব দেন। রকিব হাসান বুঝতে পেরেছিলেন যে, বড়দের উপযোগী গোয়েন্দা কাহিনীর বাইরে কিশোরদের জন্য সুস্থ, রোমাঞ্চকর ও বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীর অভাব রয়েছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরই 'দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস' সিরিজের মূল কাহিনির কাঠামোটি গ্রহণ করা হয়।
বাংলায় সূচনা ও জনপ্রিয়তা
'তিন গোয়েন্দা' সিরিজটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে, সেবা প্রকাশনী থেকে। রকিব হাসান মূল বিদেশী গল্পের প্লট বা কাহিনির কাঠামোটি বজায় রেখে এটিকে বাঙালি পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য চরিত্র ও পটভূমিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনেন। এভাবেই জুপিটার জোনস হয়ে ওঠেন বুদ্ধিদীপ্ত কিশোর পাশা (বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত), পিট ক্রেনশ হলেন বলবান মুসা আমান (আফ্রিকান-আমেরিকান), এবং বব অ্যান্ড্রুস হলেন বইপোকা রবিন মিলফোর্ড (আইরিশ)। তাদের সদর দপ্তর 'স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে' একটি গোপন আস্তানায় রূপান্তরিত হয়, যা কিশোর পাঠকদের মধ্যে বিপুল কৌতূহল সৃষ্টি করে। প্রথম বই 'তিন গোয়েন্দা' (মূলত 'কঙ্কাল দ্বীপ' নামে পরিচিত) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সাফল্য রকিব হাসানকে একটানা ২০০৩ সাল পর্যন্ত সিরিজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
কাহিনির বৈচিত্র্য ও উত্তরাধিকার
সিরিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে রকিব হাসান শুধু 'দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস'-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। গল্প স্বল্পতা দেখা দিলে তিনি পরবর্তীকালে এনিড ব্লাইটনের 'ফেমাস ফাইভ', 'সিক্রেট সেভেন' এবং 'হার্ডি বয়েজ'-এর মতো অন্যান্য জনপ্রিয় বিদেশী সিরিজের কাহিনিগুলোও নিজস্ব ভঙ্গিতে রূপান্তর করে 'তিন গোয়েন্দা' সিরিজে যুক্ত করেন। এর ফলে গল্পে বৈচিত্র্য আসে এবং কিশোর, মুসা ও রবিনের অ্যাডভেঞ্চার আরও বিস্তৃত হয়। ২০০৩ সালে রকিব হাসান লেখার কাজ থেকে সরে দাঁড়ালে সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে এই সিরিজের হাল ধরেন। এভাবে 'তিন গোয়েন্দা' সিরিজটি একটি দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার তৈরি করে, যা গত চার দশক ধরে বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের প্রিয়পাঠ্য হয়ে আছে।