কিশোর-মায়ায় কিংবদন্তি রকিব হাসান

কিশোর, মুসা, রবিন—এই তিনটি নামের একটি যদি আপনার হয়ে থাকে, তাহলে শৈশবে ফিরুন, খুব বেশি হয়তো মনে করতে হবে না, যেখানে আপনার বন্ধু বা শিক্ষক আপনাকে বলছে, ‘কী রে গোয়েন্দা, আজ আবার ফাঁকি?’ হ্যাঁ, বলছিলাম, বাংলার অন্যতম গোয়েন্দা সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দার কথা’। শিশু-কিশোরদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এই সিরিজটি হয়ে ওঠে যেন তাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধি বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। গল্পের প্রতিটি প্লটের বাঁকে বাঁকে টানটান উত্তেজনা যেন নেশা ধরিয়ে দেয় কমলমতিদের। তাই বাবা-মায়ের বকুনিও অনেক ক্ষেত্রে এই সিরিজ পাঠ থেকে বিরত রাখতে পারেনি অনেককে। সেই সিরিজের স্রষ্টা রকিব হাসান আজ আর পৃথিবীর মাঝে নেই। তিনি যাত্রা করেছেন অনন্তের পথে।
সেবা প্রকাশনীর ম্যানেজার মো. মমিনুল ইসলামের কাছ থেকে যখন জানতে পারলাম, তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান আর নেই, তখন আমার ছেলেবেলার বন্ধু রবিন, এলাকার ছোট ভাই মুসা ও সাবেক সহকর্মী কিশোরের কথা মনে পড়ে গেল। আহা! নামগুলোতে এখনও এই স্রষ্টার কাল্পনিক কল্পের ছোঁয়া আছে! অথচ মানুষটি নেই। একেই বলে, অমরত্ব। লেখক রকিব হাসান অমর হয়ে থাকবেন যুগ-যুগান্তরে।
এই সিরিজটি শুধু গোয়েন্দা কাহিনী নয়, বরং এটি সজীব এবং দারুণভাবে তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। আমার মনে হয়. ‘তিন গোয়েন্দা‘ সিরিজের মাধ্যমে বাংলা কিশোর সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়। রকিব হাসান তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদেরকে কল্পনার জগতে ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়েছেন। শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করায় শিশু-কিশোরদের জন্য উপযুক্ত হয়েছে এই সিরিজ। রহস্যে ঘেরা এই কল্পকাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান পাঠকদের মনে সৃজনশীলতা এবং চিন্তার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
রকিব হাসান শুধু ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজেই সীমাবদ্ধ নন, তার আরও বেশ কিছু বই আছে যা শিশুদের জন্য উপযোগী। তবে, তার লেখায় রহস্য, অভিযান এবং গোয়েন্দাগিরি মূল থিম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা শিশুসাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসা এবং আগ্রহকে ফুটিয়ে তোলে।
কিশোর, মুসা ও রবিনকে নিয়ে ‘তিন বন্ধু’, ‘তিন কিশোর গোয়েন্দা’ ও ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’ লিখলেও খুব একটা ছাপ ফেলেনি পাঠকের মধ্যে, যতটা তিন গোয়েন্দা ফেলেছে।
রোমহর্ষক অথচ ক্ল্যাসিক ও কিশোর উপযোগী সিরিজ লেখালেখিতে অর্ধশত বছর পার করে তিনি জীবনে পেয়েছেন প্রায় ৭৫ বছর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেশ ও বিদেশে জনপ্রিয়তায় আকাশচুম্বি হলেও বলা চলে তিনি নিজেকে সব সময় রেখেছেন খুব আড়ালে। বইমেলায় গেলে যেখানে নতুন অথবা মাঝবয়সী লেখকের পাশে পাঠকের ভিড় দেখা যেত, সেখানে বইয়ের পাশে ভিড় জমতো ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের। তাই তো খুব নতুনেরাও মিডিয়ায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টায় মশগুল থাকলেও রকিব হাসানে উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
কবিতা, গল্পে ‘ড্রাকুলা’ শব্দটি বাংলাসাহিত্যে যে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই সময়টির পাঠকের কাছে জানতে চেয়ে বুঝতে পারি, সেখানেও অবদান রকিব হাসানের। তার অনুদিত ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ এই প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য করেছিলো। তিনি অনুবাদ করেছেন—ফার্লে মোয়াট, জিম করবেট, জুল ভার্ন, এরিক ফন দানিকেন, কেনেথ অ্যান্ডারসন, মার্ক টোয়েন, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের লেখা ক্লাসিক বই।
‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’-এর কথা মনে আছে? এই বইয়ের অনুবাদ করেছেন রকিব হাসান। তিনি ‘টারজান’ সিরিজেরও অনুবাদক। এ ছাড়া তিনি সাইন্স ফিকশনও লিখেছেন।
জাফর চৌধুরী ও আবু সাঈদ নামে যদি গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে থাকেন, তাহলে একটু মনে করে দেখুন—লেখার ফ্লেবারটি কেমন? হ্যাঁ, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার লেখায় যে শব্দের গাঁথুনি, তার কাছাকাছি। বুঝতেই পারছেন, কী বলতে চেয়েছি। এই দুই নামের মানুষটিও একই ব্যক্তি। রকিব হাসান এক্ষেত্রে নিয়েছেন ছদ্মনাম।
কুমিল্লা জেলাটি যাদের ব্যক্তিত্বে পরিচিত, তাদের মধ্যে রকিব হাসান একজন। ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি এই জেলায় জন্ম নেন। বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকেই স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। লেখালেখিকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন জীবনের একমাত্র পথ।
এই কিংবদন্তি আজ বিকেল ৫টা দিকে শেষ শ্বাসটি পৃথিবীতে ছেড়ে গেছেন। কিডনি রোগে ভুগছিলেন তিনি। আজ ডায়ালাইসিস চলাকালীন শুরু হয় তার অন্তিমযাত্রা।