চিলেকোঠা
এক মুঠো আকাশ ও স্মৃতির গোপন কুঠুরি
আধুনিক শহর মানেই কাঁচ আর কংক্রিটের জঙ্গল, যেখানে জায়গা বলতে কেবলই প্রয়োজনটুকুর হিসেব। এই হিসেবি জীবনে, চিলেকোঠা নামের সেই রোম্যান্টিক শব্দটি যেন প্রায় বিলীন। ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের সংস্কৃতিতে চিলেকোঠা পরিণত হয়েছে কেবল 'স্টোর রুম'-এ, নয়তো ছাদের সাথে লাগোয়া একটি অব্যবহৃত স্থানে। কিন্তু এই নাগরিক বন্দিদশাতেও চিলেকোঠা তার পুরোনো আবেদন ধরে রেখেছে ভিন্ন রূপে।
শহরের জীবন মানেই গতির প্রতিযোগিতা, আর সেই প্রতিযোগিতায় চিলেকোঠা হয়ে উঠেছে এক শান্ত, ধীর কোণ। পুরোনো ঢাকার জরাজীর্ণ বাড়িগুলোতে এখনো চিলেকোঠা তার চিরাচরিত কাঠামোতে বিদ্যমান। সেখানে এটি শুধুই জিনিসপত্র রাখার গোডাউন নয়, বরং এক টুকরো ইতিহাস।
তবে আধুনিক বহুতল ভবনে চিলেকোঠার ধারণায় এসেছে পরিবর্তন। ছাদের কাছাকাছি অবস্থিত ছোট, নিচু সিলিং-এর কক্ষটি এখন কখনও কখনও ব্যবহৃত হয়।
নগর জীবনে চিলেকোঠা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এটি শহরের 'মুক্তির প্রতীক'। সাধারণ ফ্ল্যাট বা ঘরের জানালা দিয়ে কেবল পাশের দালানকোঠা বা নিচে চলমান জীবনের ঝলক দেখা যায়। কিন্তু চিলেকোঠার ছোট জানালা দিয়ে দৃষ্টি যায় দিগন্তে।
দিনের শেষে, এই চিলেকোঠাই হয়ে ওঠে একাকীত্ব বা অবসাদ কাটানোর নিভৃত স্থান। সেখানে বসে মিটমিটে তারা দেখা, বৃষ্টিতে টিনের চালে পড়া জলের সুর শোনা, অথবা সন্ধ্যার ঝিরিঝিরি বাতাসে বইয়ের পাতা ওল্টানো এসবই নাগরিক ক্লান্তি ভোলার মন্ত্র। চিলেকোঠার স্বল্পতা এবং একাকীত্ব যেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর ওসমানের মতোই এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বহন করে, যেখানে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা থেকে বৃহত্তর জীবনের পথে পা বাড়ানোর সুযোগ মেলে।
চিলেকোঠার ভেতরে জমে থাকা ধুলো, মাকড়সার জাল আর পুরোনো কাঠের সোঁদা গন্ধ এই সবকিছুই শহরে ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য। এই গন্ধই ফিরিয়ে আনে ফেলে আসা শৈশব বা কৈশোরের স্মৃতি। শহরের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনের বিপরীতে চিলেকোঠা যেন সময়ের গতিরোধ করে রাখে। এটি এক নীরব সাক্ষী, যে জানে পরিবারের সবথেকে পুরোনো বা গোপন গল্পগুলো।
নগর জীবনের কঠিন বাস্তবতায়, যখন প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা মূল্যবান, তখন চিলেকোঠা হয়তো উপযোগিতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এটি আজও আমাদের কল্পনার আকাশে ওড়ার জায়গা, স্মৃতিচারণের গোপন কুঠুরি, আর আকাশ দেখার এক টুকরো জানালা।

ফিচার ডেস্ক