‘আমি তোমাকে চিনি’ ধরে অনুসন্ধান, ৩০ বছর পর রহস্য উদঘাটন
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকায় আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে সগিরা মোর্শেদ নামে এক নারীকে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সগিরাকে বহনকারী রিকশাচালক ছালাম মোল্লা। ছালামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই বলছে, ওপর থেকে নিচে ময়লা ফেলা ও শ্বাশুড়ির ভালোবাসা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই ঘটনা ঘটে। আজ শুক্রবার সকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম এসব কথা এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই খুনের ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সগিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের খুঁজে বের করতে রিকশাচালক ছালাম মোল্লার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ, চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন।
পিবিআই সূত্র বলছে, যার দেওয়া তথ্যে ৩০ বছর পর এই খুনের ঘটনার রহস্য বেরিয়ে এল সেই রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। তাঁর রিকশার ওপরে বসে থাকা অবস্থায় সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় ছালামের বয়স ছিল ২৬ বছর। এখন বয়স ৫৬ বছর। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই এই খুনের ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন সগিরা মোর্শেদ। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাঁদের তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।
খুনের ঘটনা কেন?
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই খুনের ঘটনায় গত সপ্তাহে রিকশাচালক ছালাম মোল্লা আদালতকে বিস্তারিত জানিয়েছেন। পিবিআইও মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। আমরা সগিরার স্বামীর পরিবারে তদন্ত করেছি। বিস্তারিত জেনেছি।’
অভিযোগপত্রে পিবিআই বলেছে, সগিরা মোর্শেদের স্বামীর নাম আবদুস ছালাম। ছালামের বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম এবং মেজো ভাইয়ের নাম হাসান আলী। হাসান একজন চিকিৎসক। এই তিনজন রাজধানীর আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন। দ্বন্দ্বটা ছিল মূলত সগিরা মোর্শেদ ও চিকিৎসক হাসান আলীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের ভেতরে। শাহীন থাকতেন তিন তলার ফ্লাটে আর সগিরা থাকতেন দুই তলার ফ্লাটে। শাহীন তিন তলা থেকে নিয়মিত ময়লা আবর্জনা ফেলতেন। সেই ময়লা আবার সগিরার পেছনের রান্না ঘর ও বারান্দায় পড়ত। এই নিয়ে তাদের দুজনের ভেতরে ঝগড়াও হতো প্রায়। এদিকে সগিরার শ্বাশুড়ি থাকতেন তাঁর সঙ্গে। শ্বাশুড়ি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। এটা নিয়ে শাহীন ভীষণ হিংসা করতেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়মিত ঝগড়াঝাঁটির এক পর্যায়ে একদিন চিকিৎসকের স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা সগিরাকে বললেন, ‘‘আমার ভাই আনাস মাহমুদ আসলে তোকে মজা দেখাব। ঘর ছাড়া করবো তোকে।’’ মূলত ময়লা ফেলা ও শ্বাশুড়ির আদর সোহাগকে কেন্দ্র করে এই খুনের ঘটনা ঘটে।’
যেভাবে খুন করা হয় সগিরা মোর্শেদকে
মামলার তদন্ত সূত্র বলছে, সগিরা মোর্শেদের মেয়ে সারাহাত সালমা (৮) ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল। মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য বাসা থেকে সেদিন বিকেল ৫টায় রওনা হন সগিরা। পরে রিকশায় করে মৌচাকের গলি দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছালে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটরসাইকেল। এর আগে থেকেই আনাস মাহমুদ ও মারুফ রেজা সগিরাকে খুনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছিলেন। তখন মোটরসাইকেলে থাকা আনাস মাহমুদ সগিরার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকে। টানাটানি করা ওই লোকটাকে চিনতে পারেন সগিরা। তখন সগিরা মোর্শেদ ওই লোকটির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে চিনি। তুমি এখানে কেন?’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মারুফ রেজা (সন্ত্রাসী) সগিরাকে গুলি করেন। একটি গুলি লাগে হাতে আর একটি গুলি লাগে বুকের বাঁ পাশে। তখন রিকশাচালক ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করতে থাকলে লোকজন জড়ো হয়ে যায় ঘটনাস্থলে। ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে খুনিরা পালিয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সগিরাকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
এতদিন পর যেভাবে খুনিরা ধরা পড়ল
গত ১১ জুলাই হাইকোর্ট পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেন। পরে ২৬ জুন থেকে অনুষ্ঠানিকভাবে এই মামলার তদন্ত শুরু করেন পিবিআই। মামলার তদন্ত কর্মকতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি মাত্র বাক্য এই ঘটনার মোড়কে ঘুরিয়ে দিল। এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সহায়তা করল। বাক্যটি হল, ‘আমি তোমাকে চিনি।’ এই বাক্যটি বলেছিল রিকশাচালক। বাক্যটি খুনের ঘটনার সময় সগিরা আনাস মাহমুদকে বলেছিল। রিকশাচালককে খুঁজে বের করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে সেই এই মামলার মোড় ঘুরিয়েছে।পারিবারিক তুচ্ছ কারণ ও ইগোর কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটনানো হয়েছে।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে আসার আগে স্রেফ ছিনতাইয়ের ঘটনা হিসেবে চলে আসছিল। এতদিন ডিবি এই মামলার তদন্ত করেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে ঘটনাটি যদি স্রেফ ছিনতাইয়ের হতো তাহলে সাধারণভাবে সগিরার আনাস মাহমুদকে চেনার কথা না। সগিরা পুরুষ হলেও এক কথা ছিল। রাস্তা-ঘাটে দেখা হতেই পারে। কিন্তু তা তো নয়। এই চিন্তা থেকে সগিরার স্বামীর পরিবারে ঢুকে তদন্ত শুরু করি আমরা। তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলে আমরা অনেক ক্লু পাই। সেইসব ক্লু নিয়ে আমরা সামনে আগাই। চিকিৎসকের স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তাঁর স্বামীর সঙ্গেও আমাদের কথা হয়। এরপরই আস্তে আস্তে বের হতে থাকে আসল রহস্য। সাধারণ ঘটনার জের ধরে এই হত্যা সেটা তারাও স্বীকার করে নিয়েছেন। চিকিৎসক মারুফ রেজা (খুনি) ভাড়া করেছিলেন খুন করার জন্য, সেই তথ্যও জানিয়েছেন। পরে মারুফ রেজাকে ধরলে তিনিও স্বীকার করেন। সব মিলিয়ে আমরা আসামিদের গ্রেপ্তার করেছি।’

নিজস্ব প্রতিবেদক