সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি আবদুস শহিদের স্মরণ সভায় সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার ও মালিকপক্ষের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় এখন মড়ক ধরেছে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে আজ লেখক-সাংবাদিকরা চরম সংকটে রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে ডিইউজের সাবেক সভাপতি ও এনটিভির যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুস শহিদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ভার্চুয়ালি আয়োজিত এক স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল এসব কথা বলেন সাংবাদিক নেতারা।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, সাংবাদিকদের এখন কথা বলতেও ভেবেচিন্তে বলতে হয়। পরিস্থিতির কারণে শুধু গণমাধ্যমই নয়, নাগরিকরাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করছে। কিছু লিখলে বা বললে সরকারের বিরুদ্ধে যায় কি না, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যায় কি না, এটি এখন বড় সংশয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিইউজের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম। এ ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, দ্যা নিউ নেশন পত্রিকার সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ডিইউজের সাবেক সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মোরসালিন নোমানী, সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, এনটিভির পরিচালক নুরুদ্দিন আহমেদ, এনটিভির যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক ফখরুল আলম কাঞ্চন, বিএফইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক খুরশিদ আলম, ডিইউজের সহসভাপতি বাছির জামাল, রাশেদুল হক, সাবেক সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম কাগজী, সাংবাদিক নেতা মাহমুদ হাসান, সাদ বিন রাবি, একেএম মহসিন, দিদারুল আলম, আমিরুল ইসলাম অমর, গাজী আনোয়ারুল হক, খন্দকার আলমগীর হোসাইন, আবুল কালাম, রফিক মুহাম্মদ, জেসমিন জুঁই, মনির আহমেদ জারিফ প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
এ সময় রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আবদুস শহিদ ছিলেন সৎ, সাহসী ও নির্ভীক সাংবাদিক। তাঁর অকাল মৃত্যু সাংবাদিক সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। জাতির এই ক্রান্তিকালে তাঁর মতো সাংবাদিক নেতার খুব প্রয়োজন ছিল।’
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আবদুস শহিদ সাংবাদিক হিসেবে বরাবরই পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে চাননি। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। ফোরামের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ।’
শওকত মাহমুদ বলেন, ‘আবদুস শহিদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় অকপটে সত্য বলতেন। মেরুদণ্ড সোজা করে হাটার মতো সাংবাদিক কমই আছেন, আব্দুস শহিদ ছিলেন তেমন এক ব্যক্তি। তিনি গণতন্ত্রের জন্য, মুক্তমতের জন্য, কথা বলার স্বাধীনতার জন্য, সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।’
মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, ‘যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও থাকে না। আমাদের সংবিধানে বাক স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও কেউ সেটা মানছে না। বরং গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যেখানে সত্য প্রকাশেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সাংবাদিকের কলম স্বাধীন নয়, সেটি কাজ করছে উপর মহলের নির্দেশে।’
এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আবদুস শহিদের অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য কষ্টদায়ক। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সাংবাদিক সমাজ তাঁর অবদানের কথা কোনো দিন ভুলবে না।’
সভাপতির বক্তব্যে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “আবদুস শহিদ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত। তিনি যে সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করেছেন তা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকদের হওয়ার কথা ছিল ‘ওয়াচডগ’, সেখানে সাংবাদিকরা আজ সত্য কথা লিখতে পারছে না। লিখতে হচ্ছে সরকার ও মালিক পক্ষকে খুশি রেখে।”
এম এ আজিজ বলেন, ‘আবদুস শহিদ এতো অল্প সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ভাবিনি। তাঁর জন্য সাংবাদিক সমাজে এক শূন্যতা বিরাজ করছে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে শহিদ ছিলেন আপসহীন। শহিদ কথা বলত খুবই কম, আর যখন বলত তখন ন্যায় ও সততার সঙ্গে বজ্রকন্ঠে কথা বলত।’
নুরুল আমিন রোকন বলেন, দেশের সংবিধানে বাক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরে ডিজিটাল আইনসহ যেসব আইন হয়েছে, গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, ‘দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷’
কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, একটি দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকলে সেখানকার মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার ও রোহিঙ্গারা। আমি মনে করি, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বাধা দেওয়া বড় অন্যায়। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে সবসময় সোচ্চার থাকা প্রয়োজন। নয়তো স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মুক্ত সংবাদ মাধ্যমে পেশাদার সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংখ্যা কমে যাবে। যা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর জন্য বড় ধরণের ক্ষতি।
ইলিয়াস খান বলেন, ‘যে কোনো দেশেই আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে৷ সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আবার আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়৷ কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এর উল্টা প্রবণতা৷’
মোরসালিন নোমানী বলেন, ‘সাংবাদিকতার এমন প্রেক্ষাপটকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য দরকার শক্তিশালী আইনি কাঠামো ও সাংবাদিকদের ঐক্য৷ দুটিই আমাদের দেশে বিরল৷ সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকলেও তাদের শেকল পরানোর মতো আইন ও নীতিমালার সংখ্যা অর্ধশতের কাছাকাছি৷ সবশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার অপরাধী ও সাংবাদিকদের একই কাতারে সামিল করার চেষ্টা পেশাদারিত্বে শৃঙ্খল বাড়িয়েছে৷’