নোয়াখালীতে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ : ১০ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ৬
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের রাতে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১০ জনের ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) ফাতেমা ফেরদৌস আজ সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আদালত বলেন, অত্র মামলার আসামি মো. রুহুল আমিন, মো. হাসান আলী, মো. সোহেল, স্বপন, ইব্রাহিম খলিল, আবুল হোসেন, মো. সালাউদ্দিন, মো. জসিম উদ্দিন, মো. মুরাদ ও মো. জামালের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত)/০৩ এর ৯ (৩) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। এসব আসামিদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করার জন্য এবং জরিমানার অর্থ আদায় করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। তবে আসামিরা চাইলে রায় প্রকাশের ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারবে। এ ছাড়া পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হোক। এ ছাড়া আসামি মো. হানিফ, মো. চৌধুরী, মো. বাদশা আলম, মোশারফ, মো. সোহেল ও পলাতক আসামি মো. মিন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত)/০৩ এর ৯ (৩) ধারা মতে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী কৌঁসুলি সালেহ আহমদ সোহেল খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আলোচিত ওই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২৩ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে। মামলায় রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মো. মিন্টু ওরফে হেলাল (২৮) নামের এক আসামি ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আদালত ইউপি সদস্য রুহুল আমিন ও মো. হাসান আলী বুলুসহ আটজনের স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আদালত মোট ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পলাতক আসামি মো. মিন্টু ওরফে হেলালসহ ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী ও জেলা বারের সাবেক সভাপতি মোল্লা হাবিবুর রছুল মামুন বলেন, সুবর্ণচরে নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের সেই আলোচিত ঘটনার মামলার রায়ে বাদীপক্ষ সন্তুষ্ট। আদালত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন। ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামী ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. হারুনুর রশিদ হাওলাদার বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নয়। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
ওই ঘটনার পর নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বাদী বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার সময় আমি আমার স্ত্রী পারুল আক্তার এবং আমার ছেলে-মেয়েসহ ঘরে ছিলাম। হঠাৎ আমার নাম ধরে বাইরে থেকে ডাক দিলে আমার স্ত্রী পরিচয় জানতে চাইলে ‘আমি ছালা উদ্দিন’ বলে পরিচয় দেয়। ছালা উদ্দিনের বাড়ি আমার পার্শ্ববর্তী বিধায় আমার স্ত্রী দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই উপরোক্ত আসামিরা পূর্ব বিরোধের জের ধরে ঘরে ঢুকে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে আসামিরা আমার মাফলার ও আমার মেয়ের ওড়না দিয়ে হাত ও মুখ বেঁধে রেখে আমার স্ত্রীকে বাইরে রান্নাঘরের পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে আসামিরা চলে যাওয়ার সময় আমার ঘরের ছালা কোপাইয়া চলে যায়। আসামিরা চলে যাওয়ার পর কোন মতে, হাত পার বাঁধন খুলে স্ত্রীকে উদ্ধার করতে গেলে দেখি সে পুকুর পাড়ে উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে। আশপাশের লোকজনদের ডেকে তাদের সহায়তায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে রেখে আমি মামলা দায়ের করি।
এর আগে গত ২৯ নভেম্বর অধিকতর যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ১৬ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন বিচারক। তবে, রায় লেখা শেষ না হওয়ায় আদালত রায় ঘোষণার জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের রাতে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় রুহুল আমিনের নেতৃত্বে স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ঘটনার পরদিন (৩১ ডিসেম্বর) নির্যাতনের শিকার নারীর স্বামী বাদী হয়ে চরজব্বর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। পরে মামলার তদন্ত শেষে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এর আগে কড়া নিরাপত্তায় আজ সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আসামিদের জেলা জজ আদালতের হাজতখানায় হাজির করা হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে আদালত প্রাঙ্গণে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা-ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে আদালত এলাকায়। আদালতে মামলার বাদী স্বামীসহ হাজির রয়েছেন নির্যাতনের শিকার সেই নারী।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আদালত প্রাঙ্গণে আগে থেকেই বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় আদালত এলাকায়। সকাল ১০টার পর নোয়াখালী জেলা কারাগার থেকে মামলার ১৫ আসামিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে জেলা জজ আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। তখন হাজতখানার সামনে আসামিদের স্বজনদের ভিড় ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।