অভিযোগ মিথ্যা, প্রমাণ করতে পারলে সম্পত্তি লিখে দেব : বেনজীর আহমেদ
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিক। ওই খবরে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন বেনজীর।
আজ শনিবার (২০ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে বেনজির অভিযোগের জবাব দেন।
শুরুতে বেনজীর আহমেদ বলেন, চাকরিকালীন সময়ে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটি বিশেষ গোষ্ঠী কর্তৃক অবিরত এবং ক্রমাগত অপপ্রচার, এমনকি ব্যক্তিগত চরিত্র হননের শিকার হয়েছি। সাম্প্রতিক পত্রিকান্তরে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে খুবই অপত্তিজনক ও মানহানিকর অসত্য এবং বিকৃত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সংবাদের সূত্র ধরে অন্যান্য কতিপয় আউটলেট একই ধরনের সংবাদ পুনারাবৃত্তিক্রমে পরিবেশন করেছে।
বেনজীর আহমেদ আরও বলেন, তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, দেশের মূলধারার ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এ অসত্য ও মানহানিকর সংবাদ পরিবেশনে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। মূলধারার সেসব সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের অনেক কৃতজ্ঞতা। আমার অবসর গ্রহণের প্রায় দুই বছর পরে আকস্মিকভাবে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এ ধরনের মানহানিকর এবং অসত্য সংবাদ কেন প্রকাশ করল; আমি সেই আলোচনায় সচেতনভাবেই যাব না। তবে, এর কারণ রাজধানীর সব সাংবাদিক ও সচেতন মহলের মুখে মুখে।
ওই পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক এই আইজিপি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত দুই পর্বের সংবাদকে আমরা বিশ্লেষণ করেছি। এতে সব মিলিয়ে ৪৫টি তথ্য, অভিযোগ এবং অপমানজনক বক্তব্য সন্নিবেশিত আছে। এর মধ্যে ২৪টি অভিযোগ বা তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। দুটি বিষয়কে সাতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং দুটি বিষয়কে ভুল প্রেক্ষাপটে বিকৃতভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বাকি ১০টি অভিযোগ বা তথ্যকে ফুলিয়ে-ফাফিয়ে শুধু তিলকে তাল নয়, তালগাছের ঝাড় সমেত তাল বানিয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একটি একটি করে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, কৃষিক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য শতকোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে, যা মিথ্যা। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য শত শত কোটি টাকার প্রয়োজন হয় না। এখানে যে পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে, তার থেকে বেশি আমার পরিবারের ব্যাংক এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ঋণ, লোন বা দেনা রয়েছে।
শতকোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক স্ত্রী, এ সংক্রান্ত অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। পূর্বাচলে ৪০ কাঠা জমির ওপর ডুপ্লেক্স বাড়ির অভিযোগও মিথ্যা। পত্রিকার প্রতিবেদনে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে আমার এবং আমার পরিবারের যে সম্পত্তির কথা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রতিবেদন মোতাবেক ঢাকার কাছে বিঘার পর বিঘা আমাদের কোনো জমি নেই। পূর্বাচলে কথিত ডুপ্লেক্স বাড়ি নেই। ওই ডুপ্লেক্স বাড়ির পাশে একই জায়গায় ১০ বিঘা জমিও নেই।
নিজের আয় ও পারিবারিক ব্যবসার বিনিয়োগ আকাশচুম্বী সংক্রান্ত অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। আমার ৩৫ বছরের যে বেতন-ভাতার কাল্পনিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, সেটিও ভুল ও অপমানজনক। গত ১০ বছর ধরে আমার এবং আমার পারিবারিক ব্যবসা প্রকাশ্যে পরিচালিত হয়ে আসছে।
গোপালগঞ্জে সাভানা এগ্রো প্রজেক্টে ২৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে বেনজীর বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। গোপালগঞ্জ প্রজেক্টে দুটি কোম্পানির কথা বলা হয়েছে। যেখানে একটিতে ২০ কোটি টাকা, আরেকটিতে ৫ কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। সংবাদটি এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, যেন এখানে আমাদের পরিবার ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আসলে অনুমোদিত মূলধন আর পেইডআপ বা পরিশোধিত মূলধন এক জিনিস নয়। এ দুটি কোম্পানিতে এক কোটি টাকারও পরিশোধিত মূলধন বিনিয়োগ করা নেই।
প্রকল্প এলাকার নাম বেনজীরের চক প্রসঙ্গে সাবেক এ আইজিপি আরও বলেন, এটা প্রতিবেদকের নিজস্ব একটি আবিষ্কার। বেনজীরের চক নামের কোনো জায়গা প্রকল্প এলাকায় নেই। প্রকল্প এলাকায় মিটার ছাড়া বিদ্যুত সংযোগ দেওয়া হয়েছে, এ অভিযোগও মিথ্যা। সেখানে রীতিমতো সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়ে মিটার স্থাপন করে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে এবং প্রতি মাসে আমাদের পরিবার ব্যবসার কাজে যে বিদ্যুৎ বিল আসে, তা পরিশোধ করে আসছে। এখানে চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি কেনার কথা বলা হয়েছে, যেটি একটি অসম্ভব কল্পনা। এটি প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা এবং প্রকল্প এলাকাটি প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় আসন সন্নিহিত। ফলে, এ ধরনের একটি জায়গায় গায়ের জোরে বা ক্ষমতা দেখিয়ে জমি কেনার চিন্তা একটি অসম্ভব কল্পনা।
মগবাজার ও আনন্দ হাউজিংয়ের ফ্ল্যাট-বাড়ির প্রসঙ্গে বেনজীর আহমেদ বলেন, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের মগবাজারে একটি ৪ হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আছে। এটি একটি মিথ্যা তথ্য। মগবাজার কেন, সিদ্ধেশ্বরী বা রমনার আশপাশে আমাদের কোনো ফ্ল্যাট নেই। আনন্দে হাউজিংয়ে ৪০ কাঠা জমিসহ ৪৫ কোটি টাকার বাড়ি আছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। আনন্দ হাউজিং একটি বেসরকারি সমবায় সমিতি। ২০০৭ সালে আমরা এ সমিতির সদস্য হই এবং একটি প্লট বুকিং দিই। কিস্তির মাধ্যমে আমরা এই টাকা পরিশোধ করি। সেখানে আমাদের ৪০ কাঠার কোনো প্লট নেই। এটা শতগুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। আমাদের প্লটে ৫ ইঞ্চি দেওয়াল বিশিষ্ট এবং টিনের ছাদের একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। এ ধরনের একটি বাড়ির দাম ৪৫ কোটি টাকা হবে, যে হাউজিংয়ে এখনো নাগরিক সুবিধা গড়ে ওঠেনি, রাস্তা-ঘাট তৈরি হয়নি, বিদ্যুৎ সংযোগ নেই; সেখানে এ দাবি হাস্যকর।
আইজি থাকাকালীন পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট ক্রয় সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, আইজি হিসেবে নাকি আমি ফারুক মার্কেটের পাশে একটি ১০ কাঠা জমি কিনেছি, যার বাজার মূল্য ২২ কোটি টাকা। আইজি কেন, ডিএমপি কমিশনার ও র্যাবের ডিজি থাকার সময়েও আমি এখানে কোনো জমি কিনিনি। ২০০১ সালে রাজউক যখন সরকারিভাবে আবেদন আহ্বান করে, তখন আমি আবেদন করে সরকারি কোটায় একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেটি আমাদের পারিবারিক অর্থের কারণে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে পূর্বাচলে আমাদের কোনো জমি বা প্লট কিছুই নেই।
রূপগঞ্জে ২ বিঘা জমি ও বসুন্ধরায় মেয়ের জন্য ফ্লাট সম্পর্কে বেনজীর আহমেদ বলেন, রূপগঞ্জের নাওড়ায় আমাদের দুই বিঘা জমির একটি প্লট আছে, যার বাজার মূল্য দুই কোটি বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। রূপগঞ্জের আনন্দ হাউজিংয়ে একটি প্লট ছাড়া রূপগঞ্জের কোনো ইউনিয়নে আমাদের কোনো জমি নেই। এটা মিথ্যা তথ্য।
বেনজীর আহমেদ বলেন, মেয়ের বিশ্রামের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনেছি বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা সব সময় আমার সরকারি বাসা থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করত। তার বিশ্রামের জন্য বাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা আমরা কখনো অনুভব করিনি। বসুন্ধরাতে একটি আনফিনিশড ফ্ল্যাট আমরা কিনেছিলাম। বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা বসবাস উপযোগী নয়। সেজন্য, বহু আগে আমরা সেটি বিক্রি করে দিয়েছি। সেই ফ্ল্যাটে নাকি ৫০ লাখ টাকার একটি দরজা আছে। রেফারেন্স হচ্ছে, দারোয়ান। আমার প্রশ্ন, বাড়ির দারোয়ান কীভাবে জানল, এটার দাম।
দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় শতকোটি টাকার ব্যবসা সম্পর্কে বেনজীর বলেন, দুবাইতে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা, সিঙ্গাপুরে অর্ধশত কোটি টাকার স্বর্ণের ব্যবসা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াতে জমি কিনেছি বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। দুবাইতে হোটেল বা সিঙ্গাপুরে আমাদের কোনো স্বর্ণের ব্যবসা নেই। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াতে আমাদের কোনো জমি নেই। প্রতিবেদনে দুবাইয়ের কনকর্ড হলে মোটা অংকের শেয়ার রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। আমরা খোঁজ খবর করেছি, এই হোটেলটিতে কোনো শেয়ার মালিকানায় পরিচালিত হয় না। এটি একটি একক মালিকানাধীন হোটেল। এটাও মিথ্যা তথ্য।
এভাবে আরও বেশ কিছু অভিযোগের জবাব দেন বেনজীর আহমেদ। যেমন, প্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন। সেন্টমার্টিন এলাকায় নারিকেলবাগান দখলের অভিযোগের বিষয়টিও তিনি মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
বেনজীর বলেন, শেষ কথা এই যে, আমার পরিবারের যে সম্পত্তি রয়েছে, তার প্রত্যেকটির বিপরীতে অর্থের উৎস সহকারে সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স ফাইলে যথাযথভাবে সেগুলো বর্ণিত আছে। আমার পরিবার এবং আমি ব্যবসার জন্য নিয়মিত কর পরিশোধ করি। আমি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেরা করদাতার সম্মানও লাভ করেছি।
বেনজীর আহমেদ আরও বলেন, আমার ও আমার পরিবারের সম্পত্তির মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে পত্রিকায়। আমি আজ যেগুলো স্পষ্ট করেছি যে, এ ধরনের সম্পত্তি আমাদের নাই; যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমার এবং আমার পরিবারের সেই সম্পত্তি হাসিমুখে আমরা বিনা পয়সায় সেই ব্যক্তি বা গ্রুপকে লিখে দেব।