ফিরে দেখা–২০২৩
দেশের শোবিজ হারিয়েছে যেসব তারকা
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে শেষ হতে চলেছে ২০২৩ সাল। নানা কারণেই বছরটি দেশের শোবিজ অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরমধ্যে রয়েছে শোবিজ তারকাদের বিদায়। দেশের চলচ্চিত্র, সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়া এসব তারকাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকের অকাল মৃত্যু কাঁদিয়েছে ভক্তদের। ভক্তদের পাশাাপাশি তাঁদের শূন্যতা অনুভব করছে শোবিজ অঙ্গন। এই শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
চলুন, জেনে নিই বছরজুড়ে কাঁদিয়ে যাওয়া শোবিজ তারকাপ্রসঙ্গ…
সংগীত পরিচালক আনোয়ার জাহান নান্টু
শ্রোতাপ্রিয় গানের সংগীত পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার জাহান নান্টু ৭৮ বয়সে গত ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। আনোয়ার জাহান নান্টু দেশের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ভাই। ‘তুমি আমার মনের মাঝি’, ‘চোখের জলে ভেসে চলেছি’, ‘তুমি ডুব দিওনা জলে কন্যা’, ‘আমার সুখের সাথী আয়রে’র মত শ্রোতাপ্রিয় গানে সংগীত পরিচালক ছিলন তিনি।
নৃত্যপরিচালক মাসুম বাবুল
নৃত্যপরিচালক মাসুম বাবুল গত ৬ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। দীর্ঘ সিনেমা জীবনে মাসুম বাবুল প্রায় দেড় হাজারের বেশি সিনেমার কোরিওগ্রাফার ছিলেন। তিনবার জাতীয় নৃত্য পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
অভিনেতা এম খালেকুজ্জামান
একই মাসে গত ২১ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা এম খালেকুজ্জামান মারা যান। ওই দিন সকাল ৯টার দিকে নিজ বাসায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নায়করাজ রাজ্জাক ও কবরীর সঙ্গে ‘অনিবার্ণ’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা অনম বিশ্বাসের ‘দেবী’।
চিত্রনায়ক ফারুক
ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক গত ১৫ মে মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই অভিনেতা। ২০২১ সালের ৪ মার্চ থেকে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে প্রায় দুই বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়ক ফারুক বড় পর্দায় আসেন। অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন আজীবন সম্মাননায়।’
নাট্য নির্মাতা মোহন খান
জনপ্রিয় নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক মোহন খান গত ৩০ মে পরলোকগমন করেন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই নাট্যকার। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ নাটক পরিচালনা ও ২০০ নাটক রচনা করেছেন মোহন খান। সমুদ্রে গাংচিল, গাংচিল ভালোবাসা, জোনাকীর গল্প, দূরের মানুষ, মধ্যরাতের অশ্বারোহী, বেলাভূমি, সেই আমরা, নীড়ের খোঁজে গাঙচিল, জেগে উঠো সমুদ্র,আঙ্গুর লতা, হৃদয়পুরের গল্প, মেঘবালিকা ও সমুদ্র সীমানায় তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক।
অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী
প্রথিতযশা অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে গত ২৯ জুন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর প্রথম ধারাবাহিকের নাম ‘শান্ত কুটির’। শুধু টিভি নাটকই নয়, মঞ্চে ‘সূচনা’ ও ‘গুড নাইট মা’-এর মতো প্রযোজনায় নিজেকে জড়িয়েছিলেন তিনি। নাটক ছাড়াও একাধিক সিনেমাতে কাজ করেছেন গুণী এই অভিনেত্রী। মিতা চৌধুরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে–বিষ, আন্ডার কনস্ট্রাকশন ও মেড ইন বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক আশফাকুর রহমান
চলতি বছরের ১৪ জুলাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক আশফাকুর রহমান খান মারা যান। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক ছিলেন। স্বাধীনতার পর তার হাত ধরেই বাংলাদেশ বেতার গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তিনি।
প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ
একই দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন তিনি। বাঙালির বিজয়ের ঐতিহাসিক ক্ষণে কালজয়ী ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’-গানটিতে কণ্ঠ দেয়া শিল্পীদের অন্যতম- বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশ।
পান্না কায়সার
চলতি বছরের ৪ আগস্ট বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য, শহীদজায়া পান্না কায়সার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী এবং অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা।
চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী
বরেণ্য চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী গত ৩১ আগস্ট মারা গেছেন। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বার ত্যাগ করেন তিনি। নির্মাতা জহির রায়হানের আলোচিত ‘কাঁচের দেয়াল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে।
গীতিকার রাজীব আশরাফ
জনপ্রিয় গীতিকবি ও নির্মাতা রাজীব আশরাফ গত ০১ সেপ্টেম্বর মারা যান। ‘হোক কলরব’ খ্যাত জনপ্রিয় এ গানের গীতিকার রাজীব আশরাফ। বাংলাদেশের জনপ্রিয় গায়ক অর্ণবের বেশ ক’টি জনপ্রিয় গানের গীতিকার রাজীব আশরাফ। চলচ্চিত্রের গানও লিখেছেন রাজীব আশরাফ। গান লেখার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও বানিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ গেমসের জন্য বানিয়েছিলেন তথ্যচিত্র।
নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান
চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ খ্যাত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান মারা যান। বহু সফল চলচ্চিত্রের নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’। সোহানুর রহমান সোহানের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, আমার ঘর আমার বেহেশত, অনন্ত ভালবাসা।
নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী
চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী গত ১৯ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই নির্মাতা। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঘুড্ডি’ দিয়ে দর্শকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র সমালোচকদেরও মন জয় করেন তিনি। এই সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতউল্লাহ
চলতি বছর ২০ সেপ্টেম্বর একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতউল্লাহ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ১৯৮০ সালে জিনাত বরকতউল্লাহ বিটিভির নাটক ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন। নৃত্যশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন জিনাত বরকতউল্লাহ।
শফি বিক্রমপুরী
ঢকাই সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক ও পরিবেশক শফি বিক্রমপুরী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। গত ১৮ অক্টোবর ভোর চারটায় ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।
মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন শফি বিক্রমপুরী। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া সেই সিনেমার নাম ‘গুনাই বিবি’। এতে তিনি যৌথ প্রযোজক ছিলেন। পরিচালক হিসেবে শফি বিক্রমপুরীর অভিষেক হয় ১৯৭৮ সালে ‘রাজদুলালী’ সিনেমার মাধ্যমে।
সংগীতশিল্পী সুজিত রায়
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজিত রায় গত ২৩ অক্টোবর রাতে প্রয়াত হন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মঞ্চ সংগীত শিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সাংগঠনিক সম্পাদক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা।
অভিনেতা তারেক মাহমুদ
কবি, অভিনেতা ও নাট্যনির্মাতা তারেক মাহমুদ চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর মারা যান। তারেক মাহমুদের মৃত্যুতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
হুমায়রা হিমু
ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু গেল ০২ নভেম্বর মারা যান। অভিনেত্রীর মৃত্যু রহস্যজনক মৃত্যু অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম নাট্য জগতে প্রবেশ করেন। ২০১১ সালে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে হুমায়রা হিমু’র অভিষেক হয়।
চিত্রগ্রাহক এ আর আজিজ
একই দিনে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চিত্রগ্রাহক এ আর আজিজ। জানা গেছে, হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর খুব দ্রুত আজিজকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শেষে আর বাঁচানো যায়নি, ওইদিন ভোরের দিকে না ফেরার দেশের পাড়ি জমান তিনি।
নাট্য নির্মাতা মোহাম্মদ নোমান
নাট্যনির্মাতা মোহাম্মদ নোমান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের ২৬ ডিসেম্বর মারা যান। তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।