‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটির পেছনের গল্প

'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।'
গানটি বেজে উঠলেই সকলের মন দুলে ওঠে ঈদ আনন্দে। ঈদ-আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের চিরায়িত এই গানটি। এ গান বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের গহীনে অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই গানটি বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে ঈদের গান হিসেবে পরিচিত এবং ঈদ আনন্দের এক অত্যাশ্যকীয় অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ গানটির পেছনের গল্পটি হয়তো অনেকেরই অজানা? চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদের অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন। গল্পটি বলেছিলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদের ছেলে শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসি।
তিনি বলেছেন, ‘আব্বা নজরুলকে বলতেন কাজিদা। তিনি একদিন বললেন কাজিদা এই যে পেয়ারু কাওয়াল ঈদের সময় কত সুন্দর গান রচনা করে আর এইচএমভি থেকে যখন গ্রামোফোন বের হয়, হাজার হাজার কপি মুসলমানরা কিনে নেয়। তুমি এরমক একটা গান লেখো না?’
আব্বাসউদ্দীন বয়সে একটু ছোট হলেও দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই ছিল। আব্বাসউদ্দীন আহমেদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘তখনকার সময়কার রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির কর্মকর্তা ভগবতী ব্যানার্জী তখন বলেছিলেন, ‘(মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ভাষায়) আব্বাস সাহেব মুসলমানদের পয়সা নেই। তারা রেকর্ড কিনতেও পারবে না। পুজোর সময় গান বিক্রি হয়। ঈদের সময় কোনো গান বিক্রি হবে না। তবে নাছোড়বান্দা আব্বাসউদ্দীন রাজি করিয়েছিলেন এইচএমভি কোম্পানির ভগবতী ব্যানার্জীকে।’
তাঁর ভাষ্যমতে, ‘নজরুল আব্বাকে বললো পান নিয়ে আসো আর চা। আব্বা অনেকগুলো পান নিয়ে এলো। আর বললো চা আসছে। নজরুল একটা কাগজ নিয়ে এই গানটি লিখলেন। তারপর বললেন সুরটা এখনই করি না পরে করবো?
আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘কাজিদা আপনার মনের যে অনুভূতিটা, যেটা গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন এখন না করলে সেই মজাটা হবে না। এই সেই ইতিহাস।’
সেই থেকে এই গানের শুধু উত্থানই হয়েছে। এমনকি অমুসলিম শিল্পী সতিনাথ মুখার্জিসহ আরো অনেকের কণ্ঠে শোনা গেছে এই গানটি। আব্বাসউদ্দিনের ছেলে ও মেয়ে মুস্তাফা জামান আব্বাসি ও ফেরদৌসি রহমানও গানটি জনপ্রিয় করেছেন। কিন্তু গানটিকে ধীরে ধীরে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার।
তবে মুস্তাফা জামান আব্বাসির মতে, গানটি আসলে জনপ্রিয় করেছে বাংলার মুসলমান। তিনি আরো বলছেন, ‘আব্বাস উদ্দিন মারা গেছেন ১৯৫৯ সালে। তারপরে এত বছর গানটি কারা গাইলো? আমরাইতো গাইলাম। আব্দুল আলিম, আব্দুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন, এদের নাম আমরা ভুলে যাবো কেন?’ গানটি প্রথম গেয়েছেন আব্বাসউদ্দিন নিজেই। লেখার ক‘দিন পরেই রেকর্ড করা হয়েছিল।
কবি নজরুলকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম গবেষণা শুরু করেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘সেসময়কার বাঙালি মুসলিম সমাজ এই গানটি তখন লুফে নিয়েছিল।’ তিনি আরও বরেছেন, ‘এই গানটিতে ধর্মীয় ভাবধারা আর ঈদের যে খুশি সেটা খুব চমৎকারভাবে ধরা পরেছে। এই গানটি দিয়েই বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার শুরু, শোনা ও চর্চার শুরু। তিনি বলছেন, নজরুলই তার সূচনা করেছেন।
১৯৩১ সালে গানটি লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে প্রথম রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদুল ফিতরের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামোফোন কোম্পানি এই রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।’ হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১। গানটির প্রকাশকাল ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস।
গানটি রেকর্ডিংয়ের সময় আব্বাসউদ্দীন আহমদের বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। তিনি তখনও পূর্ণাঙ্গ গণসংগীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি। কিন্তু এই গানটি তাকে একজন জনপ্রিয় গণসংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। গানটি রেকর্ডিংয়ের পরবর্তী বছরগুলোতে আব্বাসউদ্দীন আহমদ গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ও বিবিসি বাংলা