হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে কী করবেন?

একটু সচেতন হলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা যায়। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৯৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. শাহাবুদ্দিন খান। বর্তমানে তিনি আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে মেডিসিন ও হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে কী করতে পারি?
উত্তর : সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যেই বিষয়টি সেটি হলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া, আমরা যাকে বলি মরটালিটি অ্যান্ড মরবিডিটি একটি মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। প্রাপ্ত বয়স্ক লোকদের একটি বিশাল অংশ মারা যাচ্ছে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে। মূলত দুটোই কিন্তু একই রোগ। যখন হার্টের রক্তনালি বন্ধ হচ্ছে আমরা বলছি হার্ট অ্যাটাক। যখন মস্তিষ্কের রক্তনালি বন্ধ হচ্ছে আমরা বলছি স্ট্রোক। পুরো জিনিসটিই আসলে এথেরোসক্লেরোসিস ডিজিজ বা রক্তনালির রোগ। এখন এই হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট কারণ কাজ করে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উদীয়মান একটি দেশের পক্ষে শুধু একা সরকার বা বেসরকারি সেক্টরের হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা কঠিন ব্যাপার। এমনকি ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও পারছে না। কাজেই আমাদের যেটা করতে হবে সেটি হলো প্রতিরোধ। প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগটি ৯৫ ভাগই কমানো সম্ভব। আসলে সবকিছুই প্রতিরোধের মাঝে। আমাদের চিকিৎসক সমাজ, সরকার, মিডিয়া প্রত্যেককে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ৯৫ ভাগ যদি আমি প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে আমি বাইপাস বা স্ট্যান বসাতে কেন যাব? খুব সহজে কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়। শুধু একটু জানতে হবে যে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে? বিষয়গুলো খুব সহজ। আপনার বয়স আমি কমাতে পারব না, লিঙ্গ আমি পরিবর্তন করতে পারব না, পারিবারিক ইতিহাস পরিবর্তন করার আমার কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু আপনার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, ধূমপান বা তামাক ব্যবহার, প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটা, খাওয়াতে প্রচুর শাক সবজি ও পর্যাপ্ত মাছ খাওয়া, মাংস বা মাংস জাতীয় পণ্যগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া এবং জীবন যাপনকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া, এগুলো খুব সহজে আমরা অর্জন করতে পারি। শুধু জানতে হবে।
এখানে একটি কথা আছে যে একজন লোক যদি প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ মিনিট চলাচল করে, তার খাদ্যাভ্যাস যদি ঠিক হয়, তার শরীরের ওজন যদি ঠিক থাকে, তার যদি ওজনাধিক্য না থাকে, তাহলে হার্ট অ্যাটাক স্ট্রোক কিন্তু অনেকাংশে কমে যায়। আমাদের দেশে ৫০ বছর বয়সে ৯০ ভাগ নারী পুরুষেরই একটি ঝুঁকি থাকে, রক্তচাপ বাড়ার। ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ লোকেরই একটি ঝুঁকি থাকে ডায়াবেটিস হওয়ার। ৬০ থেকে ৭০ ভাগ লোকেরই জন্মগতভাবে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি। ১৮ বছর বয়সে যদি নির্ণয় হয়ে যায়, আমার রক্তের চাপ কত, আমার সুগার কত, আমার কোলেস্টেরল কত, যাদের পরিবারে ঝুঁকি রয়েছে তাদের যদি যথাযথভাবে চিকিৎসা দিতে হয় এবং চিকিৎসা নেয় তাহলে সহজে হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচা যায়।
আরেকটি বিষয় বলছি আমাদের দেশের অনেক মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান না। যেসব বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খায় না, আর ফরটিফাইট দুধ খায়, ৩০ বছর পর তাদের মধ্যে কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি হয়। কাজেই হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের বীজ কিন্তু বাচ্চা মায়ের পেট থেকেই নিয়ে আসে। এটা যে ৩০ বছরে রোপণ হচ্ছে তা নয়, ৩০ বছর পর আপনি ফল পাচ্ছেন। ফল হলো হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। কাজেই বাচ্চার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, তার মানসিক পরিবেশ, তার ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ করা, জোর করে তাকে খাওয়ানো, তাকে খেলতে না দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে রাখা, তাকে পাঁচটি ছয়টি বিষয়ের মধ্য দিয়ে তার শিশুজীবনকে নষ্ট করা, এগুলো বাচ্চার ওপর প্রচণ্ড মানসিক প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে পরের ৩০-৩৫ বছর বয়সে। কাজেই আমি যেটা বলতে চাই খুব সহজ ভাষায় পৃথিবীর সবকিছুর একটি মূল্য আছে। আমরা যে বেঁচে আছি প্রতিদিনের কর্মে সবকিছুরই উপহার আছে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য কিন্তু একটি উপহার দিতে হবে।
আপনি যদি প্রতিদিন ১০০ মিনিট হাঁটেন, রক্তচাপকে যদি একশর কাছাকাছি রাখতে পারেন, এলডিএল কোলেস্টেরল যদি একশর নিচে রাখতে পারেন, আপনার সুগার যদি একশর নিচে রাখতে পারেন, আপনি যদি ১০০ ভাগ তামাক বিড়ি থেকে বেঁচে থাকতে পারেন, তাহলে আপনার পক্ষে ১০০ বছর সুস্থ জীবন সম্ভব।
প্রশ্ন : সবার মধ্যে কী এই সচেতনতাটা দেখা যায়?
উত্তর : আমাদের ঘাটতি আছে। আমার হাসপাতালে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ দিন রোগী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। আমি খুব লজ্জিতবোধ করি এতে। এটি বোধ হয় চিকিৎসক সমাজের ফেইলিউর। কারণ, সিগারেটের বিরুদ্ধে সরকার সংগ্রাম করছে। আমি দুবাইতে গত ৩৫ বছর কাজ করেছি। ওরা খুব সুন্দর একটি বিষয় করেছে। কোনো ছোটোখাটো দোকানে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। সিগারেট নিয়ে গেছে ডাওনটাওন থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে। বড় একটি সুপার মাকের্টে ৩০০ ভাগ টেক্স আরোপ করা হয়েছে। তাই পাঁচ টাকার যে সিগারেট ছিল সেটি হয়ে গেছে ২০ টাকা। একটি লোককে তিনবার চিন্তা করতে হয় সে সিগারেট খাবে কি না। একটি পর্যায়ে গিয়ে সে কিন্তু ছেড়ে দিচ্ছে। পান তামাক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে যদি খেতে দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে ফাইন করা হয়। এই কারণগুলো ঠিক না করলে বা জনগণের মধ্যে সচেতনতা না আনলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে বাঁচার আমাদের কোনো উপায় নেই এবং এটি এত ব্যয়বহুল, যখন লোকজন আসে তারা অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়ে। একটি হার্ট অ্যাটাকের পর ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ লোক প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায় এবং যদি তার হার্ট অ্যাটাকের পর যে হার্ট ফেইলিউরটা হয়, যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, ৫০ ভাগ দুই বছরে এবং মোটামুটি ১০০ ভাগই পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাচ্ছে। তাহলে আপনি যখন জীবনে সব ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে ঠিকমতো দাঁড়াচ্ছেন, ছোট ছোট বাচ্চা তখনই এই ধাক্কা। কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটা কোনো বিষয়ই নয়। প্রচুর শাক-সবজি খাওয়া এমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। গরুর মাংস, ছাগলের মাংস, লবণ কম খাওয়া তেমন কোনো ব্যাপার না।