পরকীয়ায় কি সুখ মেলে?
সমাজে, ধর্মীয় মূল্যবোধে গ্রহণযোগ্য নয়, তার পরও অনেকে জড়িয়ে পড়েন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে। আনন্দ বা সুখ পাওয়ার আশায় অনেক বাধাবিপত্তিই পেরিয়ে যান তাঁরা।
তবে এমন সম্পর্ক কি কেবলই সুখ দেয়? মনোবিদরা (সাইকোলজিস্ট) কী বলেন এ বিষয়ে?
ক্রিয়ার মেন্টাল হেলথ ইউনিটের মনোবিদ ইশরাত জাহান বীথি বলেন, পরকীয়া করলে প্রত্যেক মানুষের ভেতর একটি চাপ কাজ করে। অনুভবের মাত্রা যখন বাড়া শুরু করে, এ থেকে ভীষণ চাপ তৈরি হয়। প্রথম প্রথম হয়তো ভালো লাগে। তবে ধীরে ধীরে সেই চাপ বাড়তে থাকে। দেখা যায়, শুরুতে অনেক ধরনের প্রতিজ্ঞা করে। পরে সেগুলো রাখতে পারে না। যখন শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যায়, তখন চাওয়া-পাওয়ার জায়গাটা আর তেমনভাবে থাকে না। পরকীয়ায় মূলত শারীরিক চাহিদার বিষয়টিই বেশি থাকে।
অনেক মেয়ে ভাবেন, তাঁকে হয়তো পুরুষটি জীবনসঙ্গী বানাবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি হয় না। আনন্দটা হয়তো কিছুদিন থাকে। তবে চাপটা পড়ে তিন গুণ।
সাইকোলজিস্ট ইশরাত জাহান বীথি আরো বলেন, পরকীয়ায় কেউ জড়িয়ে গেলে অবশ্যই একজন বন্ধু নির্বাচন করতে হবে, যে তাঁকে ভালো পরামর্শ দেবে। এই চাপ থেকে বের হতে হলে মাঝামাঝি পর্যায়ে আসতে হবে। হঠাৎ করেই এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। এ সময় আবেগ অনেক বেশি কাজ করে। যুক্তি দিয়ে ভাবা যায় না। সে সময় কখন কী ধরনের আবেগ হচ্ছে, কাগজে লিখে ফেলতে হবে। খুব তীব্রভাবে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাইকোলজিস্টদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
এ রকম সম্পর্কে কেউ জড়িয়ে গেলে সমস্যা হতে পারে, এ প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এই চাপ কষ্ট দেবে। একে মেনে নিতে হবে। এভাবে ভাবলে কষ্টটা অনেকটা কমে যাবে। লিগ্যাল (নৈতিক) যেই সম্পর্ক, সেটাকে ভালো করার চিন্তা করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আসলে পরকীয়ার অধিকাংশ বিষয় নেতিবাচক। একটি সম্পর্ক থাকার সময় আরেকটি সম্পর্ক গোপনভাবে রাখার জন্য মানসিক চাপ তৈরি হয়। সংসার ও সামাজিক জীবন ব্যাহত হয়। দুটো সম্পর্ক একসঙ্গে রাখা ভীষণভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তরায়। এতে ভয় তৈরি হয়। আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হয়।
আসলে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সমাধানের পথ চিন্তা করতে হবে। হয়তো আগের সম্পর্ক ছেড়ে নতুন সম্পর্কে জড়ানো, নয়তো আগের সম্পর্কে ফিরে আসা—এটাই এর সবচেয়ে ভালো উপায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। সমস্যা সমাধান করতে হবে। অনেক সময় বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের রোগীদের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এমন হলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, পরকীয়া মাদকের মতো। এক ধরনের আসক্তি। আসক্তি প্রথমে ভালো লাগে। তবে এর পরিমাণ বাড়তে থাকলে নানাভাবে সমস্যা তৈরি করে।
পরকীয়ার সম্পর্কে অধিকারবোধের জায়গাটা যখন অতিমাত্রায় চলে আসে, তখন বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। হয়তো প্রথমে স্ত্রীর সঙ্গে থাকলে অপর মেয়েটির খারাপ লাগত না। ধীরে ধীরে হয়তো খারাপ লাগতে শুরু করে। তখন পুরুষটিকে সে হয়তো আরো সময় ধরে, বেশিক্ষণ ধরে পেতে চায়।
যেহেতু এ সময় মোহ ও আবেগের মধ্যে চলে, তাই নিয়ন্ত্রণের মাত্রা হারিয়ে যায় জানিয়ে তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, অনেক সময় সম্পর্ক ভয়ংকর একটি পর্যায়ে চলে যায়। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খুনের মতো ঘটনাও ঘটে।
ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, লুকিয়ে লুকিয়ে এ ধরনের সম্পর্ক করলে কাউকে সে পুরোটা দিতে পারে না। সেটাতে খারাপ লাগে। না একটি ম্যানেজ করতে পারে, না অপরটি। অনেক সময় ভয়ও কাজ করে, ব্ল্যাকমেইল হবে কি না। প্রচণ্ড মানসিক চাপ কাজ করে তখন।
আবার অনেক সময় যার সঙ্গে পরকীয়া করছে, সে যদি দূরে সরে যেতে চায় বা সম্পর্কটি নিয়মিত করতে না চায়,তখনো ভয়ংকর চাপ তৈরি হয়। অনেকে এই সম্পর্কের চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।
সাইকোলজিস্ট তুষার বলেন, আসলে দুটো গভীর সম্পর্ক কখনো একসঙ্গে চলতে পারে না। তখন একটি সম্পর্কের গভীরতা কমিয়ে দিতে হয়। হয়তো আগের সংসারে ফিরে আসতে হবে। আর পরকীয়ার সম্পর্ক গভীর হলে সেখানে চলে যেতে হবে। আর এমনটা না করতে পারলে সে চাপে থাকবে।
সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান, দুটো সম্পর্ক একসঙ্গে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে হবে। মানসিকভাবে নির্ভরতা তৈরি হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
এ ধরনের সম্পর্ক যেন না হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধটা বেশি জরুরি জানিয়ে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। নিজেদের সময় দিতে হবে।
সাইকোলজিস্ট বীথি বলেন, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত সময় কাটানো হয় না। তবুও যেন ফোনে একটু যোগাযোগ থাকে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। ভালোবাসার প্রকাশ করতে হবে। সেটা বলে হতে পারে বা লিখে হতে পারে।
নিজেদের মধ্যে স্বচ্ছতার অভাবেও অনেক সময় পরকীয়ার সম্পর্কে মানুষ জড়িয়ে যায়। যেমন একটি বিবাহিত মেয়েকে হয়তো কোনো ছেলে বিরক্ত করছে, এটি স্বামীকে বলার পর সে হয়তো রিঅ্যাক্ট (প্রতিক্রিয়া) করতে পারে—এ ভয়ে মেয়েটি বলে না। এই লুকোচুরিও একসময় প্রেমের দিকে ধাবিত হতে পারে। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি বলেই মনে করেন সাইকোলজিস্ট বীথি।