সিআরপি (পর্ব - ১)
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের সহায়
সদর দরজার সামনে যেতেই একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত দারোয়ান হুইল চেয়ারে বসে খুলে দিলেন দরজাটি। ভেতরে ঢুকতেই ডান দিকে দেখা গেল সিআরপির বহির্বিভাগ। এখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীরা চিকিৎসার জন্য এসেছেন। একটু ভেতরে যেতেই চোখে পড়ল খেলার মাঠ, শানবাঁধানো পুকুরঘাট, ছাত্রী হোস্টেল, নার্সারি, রোগীদের চিকিৎসার জন্য ইনডোর, যেখানে বিভিন্ন বিভাগের জন্য রয়েছে কয়েকটি আবাসিক ভবন। হুইল চেয়ারে বসে ঘুরতে দেখা গেল অনেক রোগীকে, কেউ কেউ আবার স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন, কারো সারা শরীর অবশ, মাথা আর হাত দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন নিজের চাকাযুক্ত বিছানা। তবুও সবার মুখেই হাসি। চোখে-মুখে শারীরিক অক্ষমতা জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড, সংক্ষেপে সিআরপি একটি স্বেচ্ছাসেবী ফিজিওথেরাপি সংগঠন। এখানে শারীরিকভাবে অক্ষমদের পূর্ণ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
রাজধানী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে সাভারের চাঁপাইন এলাকায় প্রায় ১৪ একর জমির ওপর অবস্থিত সিআরপির প্রধান কার্যালয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের সেবা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি বড় প্রতিষ্ঠান। বছরে প্রায় ৫০ হাজার পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকের সেবা দেওয়া হয় এখানে।
যুক্তরাজ্যের ভ্যালেরি এ টেইলরের দীর্ঘ শ্রম ও সাধনার ফসল এই সিআরপি। এই ভিনদেশি নারী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন এ দেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সেবায়। হয়ে উঠেছেন এ দেশেরই একজন।
সিআরপির কার্যালয়ের অভ্যর্থনায় রয়েছেন দুজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রিসিপশনিস্ট, যাঁরা হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। জ্যেষ্ঠ অভ্যর্থনাকারী ষাটোর্ধ্ব বয়সী গাজী মো. আশরাফ হোসেন বললেন, ‘সিআরপি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এখানকার পরিবেশটিই এমন যে, এলে সুস্থ হয়ে যাই। ১৯৯৭ সালে মিরপুরে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মাথা এবং দুই হাত ছাড়া সারা শরীরের কার্যক্ষমতা হারাই। ১৯৯৮ সালে চিকিৎসার জন্য এখানে আসি। প্রথমে রোগী ছিলাম। ২০০২ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করি। এর পর রিসিপশনিস্টের চাকরি পাই।’
আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স করেছি। এক দুর্ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সিআরপি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে।’
কথা হয় আরেকজন অভ্যর্থনাকারী সেলিনা শারমিন রুমার সঙ্গে। এক সড়ক দুর্ঘটনায় কোমরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায় তাঁর। রিসিপশনিস্টের চাকরির পাশাপাশি ছবিও আঁকেন তিনি। সিআরপির বার্ষিক ক্যালেন্ডারে ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর কয়েকটি ছবি। ৪২ বছর বয়সী রুমা সাভার অধরচন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে এলে, কাজ করলে নিজেকে আর একা মনে হয় না। অন্যদের হাঁটতে দেখলে আমি হাঁটতে পারছি না ভেবে নিজেকে দুর্বল মনে হয় না। অসহায় লাগে না। মনোবল ফিরে পাই।’
‘সিআরপিতে আইসা নিজের জীবনরে নতুনভাবে ভাবতে পারি। এই প্রতিষ্ঠান জীবনরে বদলায় দিছে। কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাত এবং এক পা হারাই আমি। ২০০২ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে আছি’—বললেন মো. আবদুস সামাদ। তিনি বহির্বিভাগে চা-বিস্কুট বিক্রি করেন। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তারা বলে, আর দোকান করা লাগব না, কাজ করা লাগব না। কিন্তু কাজ করতে ভালো লাগে আমার। নাইলে নিজেরে পঙ্গু মনে হইত, অনেক দুর্বল হইয়া পড়তাম। আমি নিজের কাজ নিজেই করার চেষ্টা করি। সিআরপি এই মনোবল বাড়াইতে সাহায্য করছে; আমিও আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি, এটা শিখাইছে।’
সিআরপির জন্মকথা
সিআরপি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট নিয়ে এর নির্বাহী পরিচালক মো. শফিক-উল ইসলাম বলেন, “সিআরপি প্রতিষ্ঠা হয়েছে মূলত ভ্যালেরি এ টেইলরের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ১৯৬৯ সালে তিনি ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ‘ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিস’ (ভিএসও)-এর হয়ে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার পাহাড়ি এলাকায় ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে কাজ করতে এসেছিলেন। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে যাঁরা প্যারালাইজড, তাঁদের সারিয়ে তোলা ফিজিওথেরাপির একটি প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি কাজ করার সময় দেখেন, এ দেশে এ বিষয়ে চিকিৎসার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। তখন তিনি এদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভ্যালেরি মাঝেমধ্যেই বলেন, তিনি এসেছিলেন কয়েক মাসের জন্য আর থেকে গেলেন অনেক বছর।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ভ্যালেরি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই আবার ফিরে আসেন যুদ্ধাহত পঙ্গুদের সেবা করার জন্য। বাংলাদেশে একটি সার্থক ফিজিওথেরাপি সংগঠন তৈরির উদ্দেশ্যে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য ১৯৭৩ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৯৭৫ সালে তিনি আবার এ দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার চার বছর পর ১৯৭৯ সালে তিনি সিআরপি প্রতিষ্ঠা করেন।
সিআরপির শুরুটা সম্পর্কে শফিক-উল ইসলাম বলেন, ১৯৭৯ সালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন ভ্যালেরি। অনেক প্রচেষ্টার পর তিনি হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত গুদামঘর পান। এখানেই ছোট পরিসরে শুরু হয় সিআরপির কার্যক্রম। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটা সময় সিআরপি নিজের পায়ে দাঁড়ায়। এর পর সাভারে প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয় ১৯৮৯ সালে। কাজ শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। সেখান থেকে বর্তমানে প্রতিবছর ৫০ হাজার লোককে প্রায় ৮০ হাজার সেশনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
শফিক-উল ইসলাম আরো জানান, সিআরপি দেশের ১১টি জেলার ৬৪টি উপজেলায় সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সব পর্যায়ের স্থানীয় প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ১৩ জেলার ১১৫টি উপজেলায় কার্যক্রম চালু করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সংস্থান কীভাবে হয়—জানতে চাইলে শফিক-উল ইসলাম জানান, এটি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে। বোর্ড অব ট্রাস্টির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান। সিআরপি ন্যাশনাল এনজিওর তালিকাভুক্ত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক এনজিওর সাহায্য নিয়ে। উৎস ছিল বিদেশি ফান্ডিং। বর্তমানে চলছে নিজস্ব অর্থায়ন এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থায়নের মাধ্যমে।
অর্থের জোগান সম্পর্কে শফিক-উল ইসলাম বলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে ৫০ শতাংশ খরচ আসে। মিরপুরে একটি ভবন আছে, সেখান থেকে ভাড়া পাই। সাভারে কিছু আছে, সেগুলোও ভাড়া দেওয়া হয়। নিজস্ব পুকুর লিজ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আছে প্রিন্টিং প্রেস, কাঠ ও ধাতুর ওয়ার্কশপ, মাশরুম চাষাবাদ, ক্যাফেটেরিয়া, ফার্মেসি। এগুলো থেকে ২০ শতাংশ খরচ আসে।’
রোগীদের সেবাদানের বিষয়ে শফিক-উল ইসলাম বলেন, “এখানে রোগীরা তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী আংশিক খরচ বা পূর্ণ খরচ দেন। যে রোগী যত পারেন, সেভাবে খরচ দেন। চিকিৎসা খরচের বিষয়টিকে ছয়টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছি আমরা—‘এ’ থেকে ‘এফ’ পর্যন্ত। রোগীরা এলে তাঁদের একটি প্রশ্নপত্র দেওয়া হয় আর্থিক অবস্থা বোঝার জন্য। সেটি পূরণ করার পর তাঁরা যে ক্যাটাগরিতে পড়েন, সে অনুযায়ী খরচ দিয়ে থাকেন। যে পারল, সে হয়তো পূর্ণ খরচ দিল। আর যে না পারল, সে আংশিক খরচ দিল। আবার কেউ হয়তো কোনো খরচই দিতে পারে না। এভাবে ৩০ শতাংশ অর্থ আসে।”
দ্বিপক্ষীয় অর্থায়ন সম্বন্ধে শফিক-উল ইসলাম বলেন, ‘২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা আসে বাইরের ফান্ড থেকে। ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস, আইএলও—এসব সংস্থা আমাদের ফান্ড দেয়। আর ২৫ শতাংশ বিভিন্নভাবে আসে। ভ্যালেরি এ টেইলরের যুক্তরাজ্যে একটি ট্রাস্ট রয়েছে, সেখান থেকে আসে ১০ শতাংশ। এ ছাড়া সরকারিভাবে সাহায্য আসে ৩ শতাংশ। মানুষ সহযোগিতা করেন, জাকাত আসে—এভাবেই এ প্রতিষ্ঠান চলে।’
পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের শারীরিকভাবে সুস্থ করে তোলাই শুধু নয়, মানসিকভাবেও শক্তি জোগায় সিআরপি। এই প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি তাই রোগীরাও একে এক যৌথ পরিবার হিসেবেই মূল্যায়ন করেন।