সিআরপি (পর্ব ২)
সেবা ও সহযোগিতার অনন্য উদাহরণ

সিআরপির উদ্দেশ্য
‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড বা সিআরপির মূল উদ্দেশ্য হলো শারীরিক প্রতিবন্ধী, বিশেষ করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করা।’ এ কথা জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক শফিক-উল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে, গাছ থেকে পড়ে, বিল্ডিং থেকে পড়ে, ভারী বস্তু টানতে গিয়ে এবং অন্য অনেক কারণে মেরুদণ্ডে আঘাত পান। সারা দেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আবার অনেক নারী যানবাহনে চলার সময় ওড়না পেঁচিয়ে স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পান। এতে অনেকেই ভীষণভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।’
শফিক-উল ইসলাম যোগ করেন, ‘এ ধরনের পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই এখানে তাঁদের চিকিৎসার পাশাপাশি কাউন্সেলিং করানো হয়। বিনোদনেরও ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের অবস্থা অনুযায়ী খেলাধুলা করতে দেওয়া হয়, যেমন—হুইল চেয়ারে বাস্কেটবল, টেবিল টেনিস ইত্যাদি খেলতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমরা তাঁদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করি। তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে শারীরিকভাবে কর্মক্ষম করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।’
চিকিৎসাসেবা
সিআরপিতে দুই ভাগে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়—ইনডোর ও আউটডোর। ইনডোরে রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আউটডোর খোলা থাকে সপ্তাহে ছয় দিন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত; আবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার অর্ধেক, সকাল ৮টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। আর শুক্রবার বন্ধ।
এখানে নানা ধরনের মেডিকেল সার্ভিস রয়েছে : ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, প্রোসথেটিকস অ্যান্ড অসথেটিকস, পেডিয়াট্রিক ইত্যাদি। নানা ধরনের স্নায়বিক সমস্যার চিকিৎসা এখানে করা হয়। স্ট্রোক, মস্তিষ্কের আঘাত, প্যারালাইসিস, ব্যথার জন্য ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত (সিপি) ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসার জন্য শিশু ইউনিট আছে। এখানে শিশুর পাশাপাশি মায়েরও থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
চিকিৎসা শেষে রোগীদের কয়েক দিন হাফওয়ে স্কুলে রাখা হয়। তাঁদের সঙ্গে পরিবারের লোকজনও থাকতে পারে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁরা কীভাবে চলাফেরা করবেন, এর জন্য এখানে রাখা হয়। এখানে সব পর্যায়ের মানুষের সুবিধার জন্য বড় ভবন থেকে মাটির ঘর পর্যন্ত রয়েছে। যেন তাঁরা যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন।
রয়েছে অপারেশন থিয়েটার, প্যাথলজি, রেডিওলজি, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সুইমিংপুল। শারীরিক অক্ষম লোকদের স্বাবলম্বী করার জন্য রয়েছে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। অনেকেই চিকিৎসার পর প্রশিক্ষণের জন্য আবার সিআরপিতে আসেন। এখানে কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র মেরামত, টেইলারিং ও এমব্রয়ডারি, দোকান চালানো, নার্সারি, পোলট্রিসহ নানা ধরনের কাজ শেখানো হয়। তবে এখানে কোনো জরুরি বিভাগের ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর রোগীকে এখানে রেফার করা হয়।
কারা এখানে চিকিৎসা দেন—জানতে চাইলে শফিক-উল ইসলাম বলেন, ‘আইনগতভাবে আমরা বিদেশি চিকিৎসক নিতে পারি না। তবে বিদেশি সাহায্যকারী ও স্বেচ্ছাসেবীরা আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁরা ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রায় ৮০ জন ডাক্তার ও ২৫০ জন থেরাপিস্ট এখানে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া রয়েছেন সাহায্যকারী স্টাফ।’
শফিক-উল ইসলাম বলেন, ‘এসবের বাইরেও যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ও বিপর্যয়ে সিআরপি এগিয়ে যায়। যেমন—রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রথম দিন থেকে সেখানকার আহত মানুষের সেবায় আমরা যুক্ত ছিলাম। সেখানে যাঁরা মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাঁদের হাত-পা অকেজো হয়ে গেছে, তাঁদের কৃত্রিম হাত-পা লাগানো হয়। এগুলো আমরা দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি করেছি। এ ছাড়া সিআরপি সড়ক দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে। তবে দুর্ঘটনার পর সেবাদানই নয়, দুর্ঘটনা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, এ বিষয়েও কাজ করছি আমরা।
শিক্ষা কার্যক্রম
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সিআরপি কাজ করে থাকে। এখানে রয়েছে বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট (বিএইচপিআই)। ১৯৯২ সাল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কয়েকশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখানে বিভিন্ন বিভাগে পড়ানো হয় : বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি, বিএসসি ইন অকুপেশনাল থেরাপি, বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি। এ ছাড়া রয়েছে এমএসসি ইন ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্স।
ভ্যালেরি এ টেইলরের সম্মাননা
স্বাস্থ্যসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয় তাঁকে।
১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভ্যালেরি এ টেইলরকে দুর্গত মানুষের সেবার জন্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ সালে তিনি আর্থার আয়ার স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ ছাড়া মানবসেবায় কাজের জন্য বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার পান তিনি।
সিআরপির ঠিকানা—
সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)
সিআরপি—চাঁপাইন, ঢাকা-১৩৪৩, বাংলাদেশ
টেলিফোন : (৮৮০)২ ৭৭৪৫৪৬৪/৫; ফ্যাক্স : (৮৮০)২ ৭৭৪৫০৬৯
e-mail : contact@crp-bangladesh.org