কিডনি আইনটি ধ্বংসাত্মক, নতুন খসড়াটিও ভুল
‘বর্তমান কিডনি প্রতিস্থাপন আইনটি ধ্বংসাত্মক। এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। আর নতুন যে আইন হচ্ছে, তার খসড়াও ভুল।’ - গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমনটিই মনে করেন।
নতুন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের খসড়া প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘ তারা বলছে, মারা যাওয়ার পর অন্য ব্যক্তি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিতে পারবে। তবে ওই ব্যক্তি কখন মারা যাবেন, তার মৃত্যুর জন্য শকুনের মতো আমি বসে থাকব? সেটা তো হতে পারে না।’
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কিডনি ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন, এর ব্যয়বহুল চিকিৎসা, কিডনি নিয়ে আইনে কী আছে এসব বলার পাশাপাশি তাঁর ছেলেবেলা, চিকিৎসাপেশায় আসা, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, সম্প্রতি চালু হওয়া গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পাঠকের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
এনটিভি অনলাইন : আপনার চিকিৎসাপেশায় আসার প্রেরণায় কে ছিলেন?
উত্তর : আসলে আমার ডাক্তারি পেশায় আসার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের ইচ্ছায় এখানে আসতে হয়েছে। মায়ের এক নিকটাত্মীয় ছিলেন ডা. হাসেম এবং মায়ের কয়েকজন কাজিন ছিলেন ডাক্তার। তাঁদের দেখে মায়েরও খুব শখ হয়, তাঁর ছেলেও ডাক্তার হবে।
আমি মা-বাবার বিয়ের নয় বছর পর পৃথিবীতে এসেছি। তাঁদের খুব আদরের ছিলাম। আদরও বেশি ছিল, অত্যাচারও বেশি ছিল। আমার মা খোদার কাছে ওয়াদা করেছিলেন, যদি ছেলে হয়, তাহলে মানুষের সেবায় উৎসর্গ করবেন।
আমি তো মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম তিন মাস ক্লাসই করিনি। যাই হোক, পরে ডাক্তারিই পড়ি। সার্জারিতে খুব উচ্চ মার্ক নিয়ে পাস করি।
একসময় মেডিকেল কলেজের ম্যাল প্র্যাকটিস (খারাপ কাজ) চোখে পড়ে। স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া, শিক্ষার্থীদের পাস না করানো। আমার মনে হয়েছিল, মেডিকেল শিক্ষা ও সেবার সংস্কার প্রয়োজন। মেডিকেল শিক্ষকদের অনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ করা দরকার। আমার ছাত্রজীবনে আমি হয়তো প্রথম ছাত্রনেতা, যে প্রেস কনফারেন্স করেছিলাম এসবের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই খবর বড় করে প্রকাশ করা হয়েছিল।
এরপর আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জড়িত থাকার কারণে নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। যাই হোক, আমার একটি বছরও বরবাদ হয়। আমি নিয়মিত পরীক্ষায় পাস করিনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করি।
আমি পরীক্ষা পাস করার এক বছর পর ইংল্যান্ডে চলে যাই। সেখানে গিয়ে এফআরসিএস প্রথম পার্ট পাস করি। ভাসকুলার সার্জারি প্রশিক্ষণ নিই। তখন মে বা জুন মাসে আমার এফআরসিএস সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা বাদ দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য চলে আসি। আমি ও ডা. এম এ মোবিন দুজনে আসি। আমরা মিলে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলি। এটা আগরতলায় ছিল। হাসপাতাল তৈরির মূল অবদান ডা. এম এ মোবিনের, আমার নয়।
কারণ, আমাকে যুদ্ধের সময় জেনারেল এমএজি ওসমানী সাহেবের নির্দেশে আন্দ্রে মার্লোর (ফ্রান্সের প্রয়াত ঔপন্যাসিক) সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। আমাকে তাঁর নির্দেশে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। তিনি ফ্রান্সের সাহিত্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন। খুব নামকরা একজন মানুষ। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ডা. মোবিনই মূলত হাসপাতালটি চালিয়েছেন।
যেহেতু আমি বিলেতে ছিলাম, জানতাম, স্বাস্থ্যসেবার প্রাণ হলো মেয়েরা। নার্স ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা চলে না। তাঁদের যথাযথ সম্মান দরকার। তাঁদের ভালো প্রশিক্ষণ দরকার। তাঁরাই রোগীর সঙ্গে একাত্ম থাকেন।
তখন একটি ঘটনা হয়েছিল। হাসপাতাল তো হয়েছিল। তবে চালাবে কে? কারণ, আমরা দুজন হলাম সার্জন। আমরা তো অস্ত্রোপচার করতে পারি। তবে এত রোগীর সেবা কে করবে? তখন আমি তাজউদ্দীন (তাজউদ্দীন আহমদ) সাহেবকে বললাম, ‘এখানে তো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। আর ভারতের নার্সরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তে কাজ করবে না। বিলাত থেকে নার্স নিয়ে আসি। অনেকে কাজ করতে চায়।’ তাজউদ্দীন সাহেব নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছু সুষ্ঠু হয় না। নিরপেক্ষ হয় না। অনেক সময় ভুলভ্রান্তি হয়। আমাদের যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয় অথবা কারো যদি পছন্দ না হয়, সে যুদ্ধ সম্পর্কে কমেন্ট করলে বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া হবে। এটা করা যাবে না।’
এখন প্রধানমন্ত্রী যদি রাজি না হন, তাহলে তো কিছু করা যাবে না। তখন বাধ্য হয়ে বিকল্প খুঁজলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, আমাদের রিফিউজি ক্যাম্পে হাজার হাজার মেয়ে বসে আছে। ছোট-বড়-মাঝারি বয়সের। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে। তারা গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে চায়। তবে আমাদের কমান্ডাররা, তাজউদ্দীন সাহেবরা রাজি নন। কারণ, অলরেডি বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, যুদ্ধে গেলে ধরা পড়তে পারে, বিভিন্ন ঝুঁকি আছে। তাই বসে থাকা ছাড়া তাদের কোনো কাজ ছিল না। তখন আমি বললাম, এদের নিয়ে স্বাস্থ্যসেবিকা বানাই। অধিকাংশই শিক্ষিত, লেখাপড়া জানা মেয়ে ছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজকর্ম শিখে ফেলল। এই ৪৮০ শয্যার হাসপাতালটা তারা চালাল। প্যারামেডিক হিসেবে তারা কাজ করল। সেটি দেখে স্বাধীনতা-উত্তরকালে, মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের মনে হলো মেয়েদের প্যারামেডিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েরাই ছিল গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাণ, স্বাস্থ্যসেবিকা।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ছেলেবেলার উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি...
উত্তর : ছেলেবেলায় কলকাতায় থাকতাম। পার্ক সার্কাসে একটি বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতাম, দোতালায়। নিচে মাড়োয়ারি, হিন্দু পরিবার থাকত। ১৯৪৬-এর সময় একটি বড় দাঙ্গা হয়। তখন কতগুলো মুসলিম লোক এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। নিচে যে হিন্দু ও মাড়োয়ারি পরিবার ছিল, তারা ভয়ে গেট বন্ধ করে দেয়। সেই লোকগুলো তখন বলছে, ‘তোমরা গেট যদি না খোল, গেট ভেঙে ঢুকব এবং আগুন দিয়ে দেবো।’ আমরা সেখানে তিন ভাই ছিলাম। একটি ভাই সদ্য হয়েছে। আমরা পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোন। আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটি তখন কয়েক মাসের। আমরা তিন ভাই, বাবা আর মা কলকাতায় থাকতাম।
আমার মা তখন আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে বাড়ির ছাদে চলে যান। মা ওপর থেকে চিৎকার করে বলেন, ‘এই তোমরা কারা?’ উত্তরে তারা বলল, ‘আমরা মুসলমান।’ মা বললেন, ‘আমিও তো মুসলমান।’ তখন তারা বলল, ‘তাহলে তো ভালো গেট খুলে দেন। এই যে হিন্দু, মাড়োয়ারিরা আছে তাদের মেরে ফেলব।’ আমার মা বললেন, ‘গতকাল যে হিন্দু কিছু লোক এভাবে এসেছিল, তখন তোমরা কোথায় ছিলে? তখন তো আমাদের মেরেই ফেলত। নিচের তলার ওই হিন্দুরাই তো আমাকে বাঁচিয়েছে। তারা তো গেট খোলেনি। তারা আমাদের রক্ষা করেছে। তখন তোমরা কোথায় ছিলে? তোমরা তো আসনি? তখন তারা বাঁচাল। আর এখন এসে তোমরা বাহাদুরি দেখেচ্ছ?’ তারা আবার বলল, ‘দরজা খুলে দাও।’ তখন মা আমার ছোট ভাইটির পায়ে ধরে উপুড় করে তাকে দেখিয়ে বলে, ‘তোমরা যদি না চলে যাও, এই যে এটি মুসলমানের ছেলে, একে আমি ওপর থেকে ফেলে দেবো। তখন এই মুসলমান সন্তান মারার জন্য তোমরা দায়ী হবে। এই দেখ, আমার আরো দুটো বাচ্চা আছে, ওপর থেকে ফেলে দেবো। তোমরা চলে যাও। তোমরা তো গতকাল আসোনি। আর এসব পরিবারের লোকেরা কোনো দোষ করেনি।’ এ কথা শুনে তারা ভয় পেয়ে চলে যায়। আমার মায়ের এই যে মানবতা বোধ, এটি আমাদের অনেক প্রভাবিত করেছে। ছোটবেলার এই ঘটনা আমার সব সময় মনে পড়ে।
আমার মায়ের নাম হাসিনা বেগম। বাবার নাম হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল আর হকি খেলতেন।
১৯৪৭-এ আমরা এ দেশে চলে আসি। আমি দুটো স্কুলে পড়েছি। একটি নবকুমার স্কুল। আরেকটি সদরঘাটের জুবিলী স্কুল। কলেজ ছিল ঢাকা কলেজ। ১৯৫৬ সালে এসএসসি পাস করি। ১৯৫৮-তে আইএসসি। আর ১৯৬৪-এ এমবিবিএস। আমি প্রায় সাত বছর বিলেতেই ছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল?..
উত্তর : গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমান সাহেব একে তাঁর ১৯ দফার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্যারামেডিক যে প্রশিক্ষণ এবং তাদের দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিস্মৃতি এটি ১৯ দফার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজ দেখে জিয়াউর রহমান খুব বিস্মিত হয়েছেন। তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাঁদের কাজ দেখেছেন। এরপর তিনি আরো চার্মড (আনন্দিত) হন গণস্বাস্থ্যের মেয়েদের সাইকেল চালানো দেখে।
আমাদের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান যে ভাইস চ্যান্সেলর, লায়লা পারভীন বানু, উনি সাভার থেকে সাইকেল চালিয়ে আসতেন। উনি আর সন্ধ্যা রায় দুজনের নেতৃত্বে ৪৬ জন মেয়ে সাভার থেকে ঢাকা পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে আসতেন। এঁদের কেউ প্যারামেডিক, কেউ অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। মেয়ে ডাক্তার তো তখনকার দিনে বেশি ছিল না, লায়লা একমাত্র ডাক্তার ছিলেন।
ফিল্ড হাসপাতালটি পরবর্তী সময়ে গণস্বাস্থ্যে রূপান্তরিত হয়। এটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন হয় ১৯৭২ সালে। আমরা নাম রাখতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। তবে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব বললেন, ‘এটা নয়। এতে একটি সরকারি ভাব আছে।’ উনি একে গণস্বাস্থ্য নামে ঠিক করে দিলেন। আমরা ১৯৭৩ সালে স্বাস্থ্যবিমা প্রচলন করি।
এনটিভি অনলাইন : এখন এই হাসপাতালের শাখা কতগুলো রয়েছে?
উত্তর : ৫০টি শাখা রয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : কত সংখ্যক মানুষ এখানে কাজ করেন?
উত্তর : সারা দেশ মিলিয়ে হাজারখানেক লোক কাজ করেন। এঁদের মধ্যে ৯০ ভাগই নারী। এখন আমরা হার্ট ও ব্রেন সার্জারি ছাড়া সব চিকিৎসাই দিচ্ছি।
এনটিভি অনলাইন : গণস্বাস্থ্যের চিকিৎসাসেবা অনেক কম মূল্যে হয়—এটি আপনারা কীভাবে করতে পারছেন?
উত্তর : খরচ কম হয়। তাই দাম কম। সোজা কথা, মনে রাখতে হবে ১৯৮২ সালে আমি যেই কথা বলেছিলাম, প্রথম বাংলাদেশে ওষুধের দাম কমিয়েছিলাম। জাতীয় ওষুধনীতি যে করা হয়েছিল, আমি তার একজন সদস্য ছিলাম। সেখানে আমি দেখিয়েছিলাম, ব্যবসায়ীরা যেকোনো কায়দাকানুন করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। ওষুধের দামও তারা সেভাবে বাড়িয়ে রেখেছিল। তাই ওষুধনীতি করে আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম, কত দাম কমানোর পরও ওষুধ কোম্পানির কত লাভ হয়। একটি উদাহরণ দিই, ১৯৮১ সালে বেক্সিমকোর সারা বছরে মোট বিক্রি ছিল মাত্র ৩৪ লাখ টাকা। স্কয়ারের সারা বছরে বিক্রি ছিল এক কোটি টাকা। আজকে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা থাকার কারণে প্রতি মাসেই তাদের বিক্রি কয়েক হাজার কোটি টাকা। কারণ হলো, এখন তাদের ওষুধের দাম কমেছে, তবে ব্যবসা অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। দাম কম থাকায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ওষুধ ব্যবহার করতে পারছে। আমি এটিই বোঝাতে চেয়েছিলাম।
এখন স্বাস্থ্য খাতে হচ্ছে কি সরকারি নীতিমালার অভাবে অত্যধিক দাম। এখন অ্যাপোলোতে যান, পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা লাগবে প্রতি সেশন ডায়ালাইসিস করাতে। আসলে সত্যিকার অর্থে এর প্রকৃত ব্যয় দুই হাজার টাকার কম।
এনটিভি অনলাইন : গণস্বাস্থ্যে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন…
উত্তর : যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো ডায়ালাইসিস সেন্টার যেমন, আমাদের ডায়ালাইসিস সেন্টার ঠিক তেমন। বিশেষজ্ঞ এনেছি অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে।
আইসিডিডিআরবি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, তার ল্যাবরেটরির যিনি প্রধান ছিলেন ডা. মাহবুবুর রহমান, তাঁকে এনেছি আমরা ল্যাবরেটরির প্রধান করে। আমরা আমাদের কর্মীদের ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষণ করিয়ে এনেছি।
আমাদের এখানে ১০০ শয্যার সেন্টারে প্রতিদিন ৫০০ লোকের ডায়ালাইসিস করতে পারব। সেখানে আমাদের প্রকৃত খরচ পড়ে এক হাজার ৭০০ টাকা, প্রতি সেশনে।
এনটিভি অনলাইন : তাহলে এত কম মূল্যে আপনারা কীভাবে এই সেবা দিচ্ছেন?
উত্তর : এখানে অতি দরিদ্রদের এক পয়সাও লাগবে না। ২৫ জন একবারে বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাবে। আর দরিদ্র মানুষ, তাদের জন্য এক হাজার ১০০ টাকা ফি।
মধ্যবিত্তদের জন্য এক হাজার ৫০০ টাকা। আর উচ্চবিত্তদের জন্য তিন হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এর নাম হলো ক্রস সাবসিডি। আমার এক হাজার ৭০০ টাকা খরচ হয়।
তবে উচ্চবিত্তদের কাছ থেকে আমি একটু বেশি টাকা নিচ্ছি। এতে আমার ক্রস সাবসিডি। এতে সাশ্রয় হয়। তবে এসব জিনিসের দাম কমাতে হলে সবচেয়ে বড় কাজ সরকারের করতে হবে। এখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন ধরেন, আমার এই ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্যের মিউনিসিপালটি ট্যাক্স হলো আট লাখ টাকা। তবে আমার পাশে যে বসতবাড়ি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আছে, তার ট্যাক্স পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা। এটি একটি অনৈতিক বিষয় নয়? স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেশি ট্যাক্স, তবে বসতবাড়িতে অনেক কম। ঠিক একইভাবে ওয়াসার যে পানি আমি নেই, সেখানেও তো ট্যাক্স দিতে হয়। সেই পানি যে বেরিয়ে যাবে, তার জন্যও আবার ট্যাক্স দিতে হয়। আজকে আপনি বসতবাড়িতে যে হারে বিদ্যুৎ বিল দেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাকে দিতে হয়। আমাকে বাণিজ্যিক হারে দিতে হয়। বাণিজ্যিক হার বসতবাড়ির চেয়ে চার গুণ বেশি।
আবার মেডিকেল যন্ত্রপাতির ওপর অত্যন্ত উচ্চ ট্যাক্স। অথচ গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতির ওপর এক ভাগ ট্যাক্স। যারা ব্যবসা করে লাভ করবে, তাদের জন্য ১ পারসেন্ট ট্যাক্স। আর আমাদের জন্য ১০ থেকে ৫৮ শতাংশ ট্যাক্স। কাজেই এ কারণে আমি বলি যে সরকার এসবে যদি সংশোধন করে দেয়, তখন চিকিৎসা ব্যয় কমানো সম্ভব হবে।
এই সেন্টারে মূল যেই টাকাটা লাগে, সেটি সাবসিডি দিয়ে কমিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর আমাদের ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচারের (প্রধান ব্যয়) ক্ষেত্রে হয়েছে কি ৩৫ হাজার বর্গফুটের বিল্ডিংটা গণস্বাস্থ্য ট্রাস্ট ১০ বছর বিনা ভাড়ায় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
আর আটজন ব্যবসায়ী আমাদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করেছেন হা-মীম গ্রুপের এ. কে. আজাদ সাহেব। বুদ্ধি, প্রেরণা ও বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ। উনার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এত দ্রুত এটি করা সম্ভব হতো না।
এনটিভি অনলাইন : অন্য জায়গায় যে ডায়ালাইসিসের দাম পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা, সেটা আপনারা এত কমে কীভাবে রাখছেন? একটু বুঝিয়ে বলুন…
উত্তর : আমরা বলি, স্বাস্থ্যকে ব্যবসায় পরিণত করা ঠিক নয়। আমার এখান থেকে কোনো লাভ করতে চাইছি না। আমার খরচটা উঠে এলেই হয়। সরকারের কাছে আমরা দাবি করছি, সরকার আমাদের রোগীপ্রতি ৬০০ টাকা সাবসিডি দিক।
এই সেন্টার করার ক্ষেত্রে কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের ভোগান্তির কিছু ঘটনা আমাকে তাড়িত করেছে।
এনটিভি অনলাইন : প্রতিবারই কি রোগীকে এক হাজার ১০০ টাকা করে ডায়ালাইসিস করতে দেওয়া হচ্ছে?
উত্তর : হ্যাঁ, প্রতিবারই। এটি খুব ব্যয়বহুল। সে জন্য আমি যেই কথাটি বোঝানোর চেষ্টা করছি সেটি হলো কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট (প্রতিস্থাপন) করতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ অনুযায়ী রক্তে সম্পর্কিত নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো জীবিত ব্যক্তি কিডনি দান করতে পারবেন না। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : এটি খুবই খারাপ আইন। এটি ধ্বংসাত্মক আইন। এটা খুবই সংকীর্ণ একটি আইন। এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর আইন। দেশের স্বার্থবিরোধী আইন বলে আমি মনে করি। অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি আইন। বাংলাদেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট (প্রতিস্থাপন) দরকার। সেখানে মাত্র ১৫০ জনের মতো লোকের বাংলাদেশে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়। অথচ ভারতে গিয়ে এক হাজার জনের মতো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করান, অন্যান্য দেশে গিয়ে আরো কয়েকশ লোক ট্রান্সপ্ল্যান্ট করান। এতে কেবল ভারতেই প্রায় ৩০০ কোটি টাকা চলে যায়। শুধু ভাইবোন, বাবা-মা ছাড়া কেউ কিডনি দিতে পারে না।
এনটিভি অনলাইন : সম্প্রতি তো একটি খসড়া আইন হচ্ছে এই বিষয় নিয়ে?
উত্তর : এটি একটি ভুল খসড়া। তারা বলছে, মারা যাওয়ার পর অন্য ব্যক্তি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিতে পারবে। তবে কখন মরবেন, শকুনের মতো আমি বসে থাকব। আপনি মারা যাবেন, ডাক্তারের দল যাবে। আপনার অঙ্গ কাটবে?
তার চেয়ে জীবিত ব্যক্তি রক্তদান করতে পারে। সম্পত্তি দান করতে পারে, টাকা দান করতে পারে। মেয়ের বিয়ে দিতে পারে। তাহলে রক্তের সম্পর্কের বাইরে আমি কেন কিডনি দান করতে পারব না। আমার দুটো কিডনি আছে। শেয়ার করতে পারব না কেন? সুতরাং আইনকে বদলানো দরকার। একজন সুস্থ মানুষ, সে চাইলে তার যদি একাধিক অঙ্গ থাকে, সে দান করতে পারবে।
এনটিভি অনলাইন : কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা তো ঘটেছে এ বিষয়ে। অন্যের কিডনি কেটে নিয়ে আসছে। তবে এর ন্যায্যমূল্য দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে?
উত্তর : ধরেন রাস্তায় যে দুর্ঘটনা হয়, প্রতিটি দুর্ঘটনা কি ট্রাকচালক করেন? এটিও তাই। ট্রাকে দুর্ঘটনা হয় দেখে, আপনি কি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন? গাড়ি নামানো বন্ধ করেছেন। এ রকম দু-চারটি কেস হয়েছে। রেস্ট্রিকটেট (বাধাগ্রস্ত) হলে এ রকম আরো হবে।
আইনকে সহজ-সরল করে দিলে বাংলাদেশে বছরে ১০ হাজার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যাবে। কেবল তাই নয়, অন্য দেশ থেকেও সস্তা বলে এসে করে যাবে।