শিশুদের দৃষ্টিস্বল্পতার কারণ কী?

বর্তমানে শিশুদের দৃষ্টিস্বল্পতা বা চোখে দেখার সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। সময়মতো এর চিকিৎসা না নিলে দৃষ্টিহানিও হতে পারে। আজ ১৫ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু চক্ষুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. ফরহাদ হোসেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : শিশুদের দৃষ্টিস্বল্পতার কারণ কী?
উত্তর : শিশুদের দৃষ্টিস্বল্পতার কারণগুলোর মধ্যে খুব বেশি যে বিষয়টা আমরা লক্ষ করি তাতে দেখা যায়, আমাদের দেশে পুষ্টিহীনতার অভাব অন্যতম একটি কারণ। যারা বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বেশি দেখা যায়। আর যারা শহর এলাকায় থাকে আমরা লক্ষ্য করেছি, ইতিহাস নিয়ে, অত্যন্ত বেশি তারা টিভি দেখে। পুষ্টিসম্পন্ন খাবার থাকার পরও, বাবা-মা বলার পরও তারা খায় না। প্রয়োজনীয় সেই খাবারটি না খেয়ে তারা বাইরের কম প্রয়োজনীয় খাবার খায়। টিভি দেখা, অত্যধিক কম্পিউটার ব্যবহার করা, মোবাইলে গেম খেলা-এগুলো একটা কারণ হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।
প্রশ্ন : জন্মগত কোনো কারণে কি শিশুর দৃষ্টিস্বল্পতা হচ্ছে?
উত্তর : জন্মগত বেশ কিছু কারণ আছে। যেমন : যদি চোখের যে আইবলটা, আমাদের যে মণিটা এই বলটার যে লেন্স সাধারণত যেটি থাকার কথা, যদি জন্মগত কোনো কারণে লেন্সটা বেশি বড় হয়ে যায় তাহলে একরকম সমস্যা হবে। যেমন : মায়োপিয়া। তারপর যদি লেন্স দেখা যায় খুব ছোট হয়ে গেছে, জন্মগত কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক। তারপরে দেখা যাক কালো মণির যে কার্ভেসার সেটাতে পরিবর্তন হয়েছে। তারপর আমাদের চোখের ভেতর যে লেন্স সেটা যদি অস্বাভাবিক অবস্থায় থাকে অথবা জন্মগতভাবে লেন্স নাই হয়ে গেল, অথবা আঘাতজনিত কারণে লেন্স নাই হয়ে গেল বা সরে গেল সে সমস্ত কারণেও সমস্যা হতে পারে। একটি শিশুর এরকম সমস্যা হলো, এসব কারণেও দৃষ্টিস্বল্পতা হতে পারে।
প্রশ্ন : এ রকম সমস্যায় করণীয় কী?
উত্তর : যখনই বাচ্চা টেলিভিশনের কাছে গিয়ে দেখবে অথবা বই খুব কাছে নিয়ে দেখছে অথবা ছবি আঁকছে খুব কাছে নিয়ে। তখন অবশ্যই তাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, পরামর্শ নিতে হবে। অথবা যদি দেখা যায় বাচ্চা মাথাব্যথার কথা বলছে অথবা মাঝে মাঝে তার চোখে চুলকানি হচ্ছে, চোখ লাল হয়ে যায়, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রতিটি বাচ্চার ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি যে স্কুলে দেওয়ার আগে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রি-স্কুল চেকআপ করতে হবে। তাহলে দৃষ্টিস্বল্পতার কারণ বুঝতে আমাদের জন্য সহজ হবে।
প্রশ্ন : বেশির ভাগ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের যে প্রেক্ষাপট সেখানে প্রি-স্কুল চেকআপ হয় না। এমনকি স্কুলে যায়, যে বাচ্চারা তাদেরও চেকআপ করা সম্ভব না বা হচ্ছে না। আপনি যে লক্ষণগুলোর কথা বললেন সেগুলো আপনাদের কাছে নিয়ে এলে কী করেন?
উত্তর : অনেক সময় এমনও হয় খুব ছোট বয়সের বাচ্চারাও হয়তো চোখে দেখে না। তখন আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের দৃষ্টিটাকে মেজার করি সে আসলেই কতটুকু দেখে। যেমন ধরুন একটা ছোট বাচ্চা, একটা নবজাতক শিশু সে দেখে কি না সেটা দেখতে আমরা বাচ্চার এক চোখ হয়তো ঢেকে দিলাম। যদি ঢেকে দেওয়ার পর বাচ্চা আমার হাতকে সরিয়ে দেয় তাহলে দেখতে হবে তার দৃষ্টিটা ভালো আছে। আর যদি না সরিয়ে দেয় তাহলে বুঝতে হবে ওই চোখে তার দৃষ্টিটা কম আছে। এভাবে পরিমাপ করি। তারপরে বিভিন্ন প্যারামিটার আছে সেগুলো দিয়ে আমরা দেখি তার দৃষ্টিটা কতটুকু ঠিক আছে। যদি দৃষ্টি কম থাকে, তখন আমরা বিভিন্নভাবে করি সঠিকভাবে পরীক্ষা করি। ছোটদের ক্ষেত্রে এট্রোপিন দিয়ে পরীক্ষা করি। এবং বড়দের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো এট্রোপিন না দিয়েও পরীক্ষা করি। পরীক্ষা যাই করি, তখন রিফ্লাংকটিভ ইরোর আছে কি না সেটি পরীক্ষা করি। যদি দেখি রিফ্লাংকটিভ ইরোর থাকে, সঙ্গে সঙ্গে চশমা দিই। তবে অনেকের ধারণা, ছোটবেলায় যদি চশমা দেওয়া হয় তাহলে হয়তো সারা জীবনই চশমা দিতে হবে। আসলে এই ধারণা ভুল। যদি চশমা না দেওয়া হয়, তাহলে স্থায়ীভাবে তার দৃষ্টিহানি ঘটবে। এখানে এমব্লোয়পিয়া নামক এক রোগে তার দৃষ্টি চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : কেউ যদি যতদিন চশমা পরা উচিত, ততদিন না পরে তাহলে কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : তাহলে ক্ষতি হবে। তখন চশমা পরা আর না পরা একই হবে। সুতরাং চশমা যদি চিকিৎসক দেন তাঁর পরামর্শ অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে ফলোআপে যেতে হবে। চিকিৎসক যদি পাওয়ার কমে, কমিয়ে দেবেন। বাড়লে, বাড়িয়ে দেবেন। ঠিক এইভাবে যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা যায়, তবে অবশ্যই দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসবে এবং চশমা পরবর্তীকালে নাও লাগতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুদের এই দৃষ্টিস্বল্পতা দৃষ্টিহীনতায় রূপান্তরিত হতে পারে কি না। এবং এর ঝুঁকি কতটুকু?
উত্তর : যেসব বাচ্চার চশমা লাগে অথচ চশমা পরে না। যে সমস্ত বাচ্চা নিয়মিত চশমা পরে না। এবং চশমা পরার পাশাপাশি আমরা কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকি যেমন পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার তাকে খেতে হবে। পর্যাপ্ত আলোতে লেখাপড়া করতে হবে। টেলিভিশন কম দেখতে হবে। মাছের কাটা খেতে হবে। কারণ মাছের কাটায় চোখের যে উপাদানগুলো দরকার সেগুলো থাকে। তারপর ফলমূল বেশি খেতে হবে। ডিমের কুসুম, মাছ এগুলো খেতে হবে। এসব জিনিস মেনে চললে দৃষ্টিস্বল্পতা থেকে দৃষ্টিহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। আর চশমা পরার পাশাপাশি এগুলো যদি না মেনে চলে তাহলে হয়তো দীর্ঘদিন তাকে চশমা পরতে হবে।
প্রশ্ন : এসব অবহেলার কারণে কোনো শিশু অন্ধত্বের দিকে যেতে পারে কি না?
উত্তর : এসব অবহেলার কারণে অবশ্যই দৃষ্টিহানি ঘটবে। যাকে আমরা বলি এমব্লয়পিয়া হবে। এর ফলে রোগী চিরতরে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়বে, যেটা পরবর্তীকালে অস্ত্রোপচার বা উন্নতর চিকিৎসার মাধ্যমে আর ভালো করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া টেরা চোখ হয়ে যেতে পারে। যদি সঠিক সময়ে চশমা ব্যবহার করা না হয় তবে চোখ টেরা হয়ে যাবে। আবার সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দৃষ্টিশক্তির কোনো উন্নতি হয় না।
প্রশ্ন : টেরা চোখ কি তার ভবিষতে কোনো সমস্যা করতে পারে?
উত্তর : আমাদের গ্রামেগঞ্জে অনেকেরই ধারণা রয়েছে টেরা চোখকে লক্ষ্মী টেরা বলা হয়। কিন্তু যখনই আপনি দেখবেন তার চোখ টেরা বুঝবেন যে ওই চোখের দৃষ্টি অনেক কম। এই লক্ষ্মী আসলে লক্ষ্মী নয়, অলক্ষ্মীর শুরু। যথাসময়ে যদি এর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে দৃষ্টিহানি ঘটবে। আর যদি যথাসময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা না করা হয়, তবে দৃষ্টিশক্তি পূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসবে।