শীতে বয়স্কদের সুরক্ষা
শীতে কাবু পুরো দেশ। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার শীত পড়েছে অনেক বেশি। শীতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। মৃতদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। অসহায় বয়স্কদের দেখার নেই কেউ। বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় শীতে অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।
শীতে বয়স্কদের মারা যাওয়ার কারণ সম্বন্ধে লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক বিল কিয়েটিনজ বলেন, ‘শীতে ঠান্ডার কারণে মারা যায় খুব কম। মারা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে।’
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শরীর থেকে তাপ যেন বাইরে যেতে না পারে এবং শরীর গরম রাখার জন্য রক্ত ত্বকের রক্তনালিতে চলাচল করে খুবই কম। বেশির ভাগ রক্তই হার্ট ও ফুসফুসে চলাচল করে। এতে করে দেহে বাড়তি ফ্লুইড হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দেহ থেকে লবণ ও পানি বের করে দেয়। ফলে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। রক্তনালিতে রক্ত সহজেই জমাট বেঁধে যায়। দেখা দেয় স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক। তরুণদের রক্তনালি বেশ স্বাস্থ্যবান বলে এ সমস্যা কম দেখা দেয়।’
বৃদ্ধদের মারা যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শ্বাসনালির প্রদাহ প্রবীণদের মারা যাওয়ার আরেকটি কারণ। শীতে ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লু থেকে হতে পারে নিউমোনিয়া, যেটি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া হতে পারে সিওপিডি ও অ্যাজমা। বেড়ে যেতে পারে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও যেকোনো গাঁটে ব্যথার জটিলতা। হতে পারে ভাইরাল জ্বর ও ডায়রিয়া।’
রোগ প্রতিরোধে করণীয়
ঠান্ডার কারণে এ সমস্যাগুলোয় আক্রান্ত হচ্ছেন বৃদ্ধরা। এ জন্য ঠান্ডা থেকে তাঁদের দূরে থাকতে হবে। পরিমিত শীতবস্ত্র পরতে হবে। বুক, কান ও পায়ে ঠান্ডা বেশি অনুভূত হয়, তাই এসব অঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে। একটি মোটা কাপড় পরার চেয়ে কয়েকটি পাতলা কাপড় পরলে ঠান্ডা কম লাগবে।
কাপড়ের স্তরে স্তরে বাতাস জমা হয়ে দেহ থেকে তাপ বাইরে বের হতে বাধা দেবে। গলা ও কানে কাপড় জড়িয়ে ঘুমাতে হবে। মাফলারে মাথা ঢেকে ঘুমান। মাথা দিয়েও তাপ দেহের বাইরে যেতে পারে। রাতে ঘুমানোর সময় কাপড় যেন সরে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখুন। বাইরে বের হলে যথেষ্ট পরিমাণে শীতের কাপড় পরুন। বাইরে বেশিক্ষণ থাকবেন না। হাতমোজা ব্যবহার করুন। পায়ে উলের মোজা বা জুতা পরুন।
ঘরের মধ্যে শুধু শুয়ে থাকবেন না। কিছু কিছু শারীরিক পরিশ্রম করুন। এতে করে আপনার শরীরে তাপ উৎপন্ন হবে। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করুন। হাত-পা নাড়াচড়া করুন।
গরম গরম খাবার খান। ঠান্ডা খাবার পারতপক্ষে পরিহার করুন। ঠান্ডা পানি পান না করে গরম পানি পান করুন। গরম চা, কফি খেতে পারেন। প্রতিদিন কিছু না কিছু টক ফল খান। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
ফ্লুতে আক্রান্ত হলে খেয়াল রাখুন যেন তা নিউমোনিয়ায় রূপ না নেয়। জ্বর, কাশি, কফ ও শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিভিন্ন অসুখ, যেমন—অ্যাজমা, সিওপিডি, বিভিন্ন ধরনের গাঁট ব্যথার জন্য যাঁরা আগে থেকেই ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের ডোজ প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিতে পারেন। শীতের আগে ইনহেলার অনিয়মিত নিলেও এখন নিয়মিত নিতে হতে পারে।
ধূমপান করলে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। এ ছাড়া সিওপিডি ও অ্যাজমা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই ধূমপান একবারেই পরিহার করুন।
শীতে হাত ও পায়ের আঙুলে রক্ত সরবরাহ কম হয়। এ জন্য ঠান্ডায় আঙুলে ইসকেমিক আলসার হতে পারে। একে ‘ফ্রস্ট বাইট’ বলে। এ ক্ষেত্রে ত্বকের রং পরিবর্তন হয়ে ব্যথা হয় এবং পরে নীল হয়ে যায়। আঙুলে যেন ঠান্ডা না লাগে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। শীতের সবুজ শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার, যেমন—ভ্যাসলিন, গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল ও সরিষার তেল ব্যবহার করা যায়। গোসলের আগে নয়, গোসলের পর গা ভেজা ভেজা থাকতেই এগুলো ব্যবহার করুন।
ডায়রিয়ামুক্ত থাকতে চাইলে বাসি খাবার খাবেন না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। ডায়রিয়া হয়ে গেলে প্রচুর পানীয় পান করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বুকে ব্যথা অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।