পলিসিস্টিক ওভারি কেন হয়?

ডিম্বাশয়ের মাঝে অনেক সিস্ট হলে তাকে সাধারণত পলিসিস্টিক ওভারি বলা হয়। আজ ৩০ ডিসেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৫১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাইমা শারমিন হক।
প্রশ্ন : পলিসিস্টিক ওভারি জটিল একটি নাম। শুরুতে একটু জানতে চাইব, পলিসিস্টিক ওভারি বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আসলে পলিসিস্টিক ওভারির মানে হচ্ছে ওভারির (ডিম্বাশয়) ভেতর অনেক ছোট সিস্ট। সাধারণত প্রতি মাসে মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে একটি করে ডিম্বাণু পরিপক্ব হয়ে বের হয়ে আসে। যার কারণে মেয়েদের প্রতিমাসে মাসিকের চক্র ঠিক থাকে। তবে যাদের পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রতিমাসে একটি করে ডিম্বাণু পরিপক্ব না হয়ে অনেক ডিম্বাণু একসাথে পরিপক্ব হওয়ার চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনোটাই খুব বেশি পরিপক্ব হয় না যে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসতে পারবে। এই কারণে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়। এটাকে ‘এন অভুলেটরি’ সাইকেল বলা হয়। এ বিষয়টির সাথে আরো অনেক কিছু জড়িত থাকে। যেমন : এই সমস্যার সাথে তার অনিয়মিত মাসিক হয়, কারো দেখা যায় অনেক দেরি করে মাসিক হচ্ছে, অথবা কারো কারো অনেকদিন ধরেই হয় না। এর সাথে তার ওজনাধিক্যের সমস্যা থাকে, অবাঞ্চিত লোমের সমস্যা থাকে- অনেকগুলো বিষয় আসলে চলে আসে। একে সম্মিলিতভাবে বলা হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রম। এর সাথে বন্ধ্যাত্বের বিষয়টিও জড়িত।
প্রশ্ন : পলিসিস্টিক ওভারির লক্ষণগুলো কী?
উত্তর : পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রমে যারা ভোগে, তাদের সবারই একটি প্রচলিত বিষয় থাকে ওজন বেড়ে যাওয়া। হঠাৎ করে ওজন বেড়ে যায়। হঠাৎ করে অবাঞ্চিত লোম বেড়ে যায়। যেমন: ঠোঁটের উপর লোম, মেয়েদের গালে লোম- এই জিনিসগুলো হয়।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন বয়সে বিষয়টি বেশি হয়?
উত্তর : সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় যখন থেকে মাসিক শুরু হয়, তার কিছুদিন পর থেকে এই সমস্যা হতে পারে। তবে আমাদের সমস্যা হলো, তখন থেকে আমরা বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেই না। পরবর্তীকালে যখন দেখা যায়, বিয়ে হয়ে গেছে বা বিয়ের পর গর্ভধারণ করছে না, তখন রোগী বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে, তখন পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় সে পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যায় ভুগছে।
প্রশ্ন : তাহলে কখন একজন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
উত্তর : অবশ্যই অনেক আগে যাওয়া উচিত। যেহেতু একজন মেয়ের জন্য মাসিক অনেক বড় ব্যাপার, তার স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য, গর্ভাবস্থার জন্য, মানসিক শান্তির জন্য। এ কারণে যদি কারো মাসিক অনিয়মিত থাকে, যদি সেটা দেড় মাসের বেশি থাকে, যদি সেটা দেড় মাস থেকে দুই মাস পরপরও হয়, তারপরও অবশ্যই উচিত, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। আবার যদি কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, হঠাৎ করে ওজন বেড়ে যাচ্ছে, তখন সেক্ষেত্রেও তাকে সতর্ক হওয়া উচিত। যারা সচেতন তারা আসলে চিকিৎসকের কাছে চলে আসে।urgentPhoto
প্রশ্ন : এই সমস্যা নিয়ে এলে আপনারা সাধারণত রোগীদের জন্য কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : পরামর্শ নির্ভর করে আপনার কাছে কী সমস্যা নিয়ে আসছে তার ওপর। যদি কেউ কেবল মাসিকের সমস্যা নিয়ে আসে তাদের আমরা বলি, তাদের জন্য প্রথম চিকিৎসা হবে ওজন কমিয়ে ফেলা। এটার জন্য সে ব্যায়াম করতে পারে। হাঁটতে পারে। প্রয়োজনে ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ নিতে পারে।
আসলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। এর জন্য হাইপার এন্ড্রোজেনিজম হয়। এন্ড্রোজেন হচ্ছে, পুরুষ হরমোন। মেয়েদের শরীরের যদি পুরুষ হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখনই দেখা যায়, ওজন বাড়তে থাকে, লোম গজাতে থাকে, মাসিক অনিয়মিত হতে থাকে। তখন আমরা তাদের বলি ব্যায়ামের পাশাপাশি মেটফরমিন নামের একটি ওষুধ নিতে। যেটা তার এন্ড্রোজেনের মাত্রাকে কমিয়ে দেবে। যখনই এন্ড্রোজেনের মাত্রা কমে যাবে, তখনই এই উপসর্গগুলো ঠিক হয়ে যাবে। যদি ঠিক সময়ে নেওয়া হয় তাহলে ডিম্বাণুর পরিপক্বতা ঠিক থাকে, মাসিক নিয়মিত হয়ে যায়। আর যদি কেউ বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে আসে তাদের জন্য পরামর্শ থাকে ল্যাপারেস্কোপি করা।
আমাদের কাছে যখন এসে বলে বাচ্চা হচ্ছে না, তখন আমরা যখন চিকিৎসা শুরু করতে যাই তখন দেখা যায় তার মাসিক অনিয়মিত। তখন আমরা জিজ্ঞেস করি আপনি কী এর আগে আরো অনেক শুকনা ছিলেন? আপনার ওজন কি হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে? যদি বলে হ্যাঁ এবং সবকিছু মিলে যখন আমরা পরীক্ষা করি, তখন আমরা দেখি সে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে ভুগছে। এটা শুধু মেয়েদের জন্য। আসলে বন্ধ্যাত্বের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দায়ী থাকতে পারে।
পলিসিস্টিক ওভারি থাকলে দেখা যায় আমরা ল্যাপারেস্কোপ করি। ছোটো ছোটো অনেক সিস্টকে পাংচার (টুকরো) করে দেওয়া যায়। এটি করলে ভেতরে যে বাড়তি এন্ড্রোজেন থাকে, সেটি বের হয়ে যায়। হয়ে গেলে হরমোনের ভারাসাম্যহীনতা ঠিক হয়ে গিয়ে মাসিক ঠিক হয়ে যায়। ল্যাপারেস্কোপি করার পর দেখা যায় খুব দ্রুত সন্তান ধারণ করে ফেলে।
প্রশ্ন : যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে কি কি জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : আসলে বন্ধ্যাত্ব তো একটি বড় জটিলতা। বয়স চলে গেলে চাইলেও আপনি গর্ভধারণ করতে পারবেন না। আমরা পরামর্শ দেই ৩০ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে অবশ্যই একটি মেয়েকে গর্ভধারণ করতে হবে। এরপর যত দেরি হতে থাকবে তার বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা বাড়তে থাকবে। যেহেতু তার মাসিক বন্ধ থাকে ইউটারিন ক্যানসারের একটি আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় ডায়াবেটিসও ধরা পড়ে। একটি সমস্যার কারণে অনেক রোগ হচ্ছে।
প্রশ্ন : কী কী কারণে এই সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : প্রথম কারণ হলো ওজন। খাবার যারা ভালোবাসে তাদের হতে পারে। জেনেটিক কারণে হতে পারে। আর কিছু অজানা কারণও রয়েছে।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের জন্য কী করতে হবে?
উত্তর : ওজন কমাতে হবে। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। তেল জাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। আসলে উপসর্গ দেখার আগে প্রতিরোধের চেষ্টা করা প্রয়োজন। আর যদি ন্যূনতম উপসর্গ দেখা দেয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা উচিত।