মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের চিকিৎসা কী
সাধারণত ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্য সেবন হেডনেক ক্যানসার বা মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের জন্য দায়ী। আজ ১০ জানুয়ারি, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৬২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. রশিদ উন নবী। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : হেডনেক ক্যানসার মানে কী? শরীরের কোন অংশে হলে একে হেডনেক ক্যানসার বলে?
উত্তর : হেড মানে মাথা; নেক মানে ঘাড়, এখানে গলার অংশও আছে। হেডনেক ক্যানসার বলতে বোঝায়, মুখগহ্বর থেকে শুরু করে জিহ্বা, গাল, মাড়ি, দাঁত, স্বরযন্ত্র—সবকিছুর ক্যানসারকে। আসলে মুখ থেকে শুরু করে চোয়ালসহ দাঁতের মাড়ি, দাঁতের পেছনের অংশ, জিহ্বা, জিহ্বার পেছনের অংশ, স্বরযন্ত্র, নাকের পেছনে ন্যাজোফ্যারিং—সবকিছু মিলিয়ে হচ্ছে মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসার।
প্রশ্ন : এ অঞ্চলে সাধারণত কী ক্যানসার হয়?
উত্তর : বাংলাদেশে আমরা যদি পুরুষদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ফুসফুসের ক্যানসার বেশি হয়। এরপরই রয়েছে মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসার। জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি—এসব ক্যানসার দ্বিতীয় অবস্থায় রয়েছে।
প্রশ্ন : কোন বিষয়গুলো মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়?
উত্তর : আমাদের মাথা, ঘাড়ে তো অনেক জিনিস রয়েছে। এর মধ্যে স্বরযন্ত্রের ক্যানসার আছে। এখানে ধূমপান প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া তামাক, সাদা পাতা, গুল—এগুলো যদি আমরা ব্যবহার করি, জিহ্বার মধ্যে অনেকক্ষণ আমরা চিবাই, রেখে দিই, সেখানে থেকে দাঁতের মাড়ি, জিহ্বা, জিহ্বার পেছনের অংশ—এসবের ক্যানসারের সঙ্গে সেগুলোর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। শ্বাসনালি, খাদ্যনালির ক্যানসারের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক কম। এর জন্য ধূমপানই বেশির ভাগ দায়ী।
আমাদের খাবার-দাবার, কিছু ওষুধের জন্য দায়ী। মূলত মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের সঙ্গে জড়িত ধূমপান এবং তামাক, সাদা পাতা, পান, সুপারি ইত্যাদি।
প্রশ্ন : একজন মানুষ মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হলে কী ধরনের সমস্যায় হয়? এবং কখন চিকিৎসকের কাছে রোগী যাবেন?
উত্তর : মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের একটি সুবিধা রয়েছে, একে প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা যায়। জিহ্বা বা মাড়ি এগুলোতে প্রথমে ক্যানসারটি আলসার হিসেবে দেখা দেয়। একটি ঘায়ের মতো হয়। ঘা দীর্ঘদিন থাকতে পারে। দেখা যাবে, ঘা শুকাচ্ছে না।
অনেক সময় ডায়াবেটিসের জন্য আলসার হতে পারে। দেখা গেল, রোগীর ডায়াবেটিস হয়তো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে ঘা শুকাচ্ছে না। তাই আমরা ক্যাম্পেইন করার সময় বলি, ‘সহজে সারছে না এমন কোনো ক্ষত’, এ রকম হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, জানতে হবে বিষয়টি কী? কখনো কখনো ভিটামিনের অভাবে আমাদের ঘা হতে পারে। অটোইমিউন রোগের জন্য ঘা হতে পারে। ডায়াবেটিসের জন্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীর ইতিহাস নিতে হবে। তার ধূমপান করার ইতিহাস আছে কি না, দেখতে হবে। পান-জর্দা, সাদা পাতা, তামাক গ্রহণ করার ইতিহাস আছে কি না, সেগুলো দেখতে হবে।
এটা গেল একদিক। আর আরেকটি হলো, ধূমপানের জন্য আমাদের স্বরযন্ত্র বসে যায়। আমাদের সর্দি-কাশি লাগলেও গলার স্বর বসে যায়। তবে সেটা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যেতে পারে। দেখা গেল কিছু লোকের ভাঙা কণ্ঠস্বর। এই ভাঙা কণ্ঠস্বর যদি ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হয়, তখন আমরা বলি, অবশ্যই আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
এ ছাড়া এই ক্যানসারে গলার পাশে ফুলে ওঠে, নডিউল হয়। এটি অগ্রবর্তী পর্যায়ে হয়। অনেকে এগুলো নিয়ে বসে থাকে। এর পর দেখা গেল এই রোগ ধীরে ধীরে ওখান থেকে ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এমন দেখেছি, মূল রোগটি হয়তো ছোট, তবে এখানে অনেক বড় বড় নোড রয়েছে। আমাদের দেশে আসলে সচেতনতার অভাবে রোগ বাড়ে। বিদেশে কিন্তু অনেক প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে চলে আসে।
প্রশ্ন : মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসার হলে এর চিকিৎসার ধরনগুলো কী কী?
উত্তর : যদি ওরাল ক্যাভিটিতে কোনো ক্যানসার থাকে, জিহ্বা অথবা এর আশপাশের জায়গাগুলোতে, সেগুলোর প্রথম চিকিৎসা আসলে সার্জারি। অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসায় কোনো ভালো ফল আসে না। তবে আবার কিছু কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে অস্ত্রোপচার করা যায় না। যেমন : নাকের ভেতর ন্যাজোফেরিংস, জিহ্বার গোড়া। এই জায়গাগুলো সার্জারি করা সহজ নয়। সে জন্য ওই জায়গাগুলোতে রেডিয়েশনের সঙ্গে কেমোথেরাপির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
আবার আমাদের স্বরযন্ত্রের ক্ষেত্রে, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে বলা হতো অস্ত্রোপচার প্রধান চিকিৎসা। সার্জারি করলে অনেক বেশি জটিলতা হয় গলায়। এর জন্য রেডিয়েশন থেরাপির সঙ্গে কেমোথেরাপি একটি বড় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং জায়গা বুঝে চিকিৎসা করতে হয়। তবে মুখগহ্বরের ভেতরে যে কিছু আছে, সেটার প্রথম চিকিৎসা আসলে সার্জারি। অস্ত্রোপচার করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে চিকিৎসা করলে অত ভালো ফল পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন : একটি রোগের জন্য শুধু সার্জারি যথেষ্ট, নাকি রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি লাগবে—এটি কিসের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর : ক্যানসার এমন একটি রোগ, যাকে একটি পদ্ধতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এটা পৃথিবীতে সম্ভব নয়। এ জন্য ক্যানসারের তিনটি প্রধান চিকিৎসা হলো সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। অনেক সময় এখানে তিনটি একসঙ্গে করার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় জায়গা বুঝে শুধু সার্জারি করলে হয়। অনেক সময় জায়গা বুঝে শুধু রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি করলেও হয়। তবে একটি চিকিৎসায় এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মিলিত চিকিৎসা করতে হয়। এই মিলিত চিকিৎসায় আমাদের বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। একটি মাত্র চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মূলত মিলিত চিকিৎসাই ভালো।
আমরা যখন ক্যানসার নির্ণয় করি, সেখানে দেখি পর্যায়টি কেমন রয়েছে। অনেক সময় বই-পুস্তকে লেখা থাকে, কিছু কিছু জায়গায় কেবল অস্ত্রোপচার করলেই হবে। তবে আমরা কখনো কখনো দেখি, অস্ত্রোপচার করার পর ওই রোগী ওই জায়গার ক্যানসার নিয়েই আসছে। তাই একটু বেশি চিকিৎসা করাই বোধ হয় ভালো। বাংলাদেশে তো আমরা একদম ঠিক জায়গায় সবকিছু করতে পারি না। তাই চিকিৎসকরা যেভাবে ভালো মনে করবেন, সেভাবেই সামনে এগোবেন।