থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসা কী
থাইরয়েড খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি আমাদের শরীরে। এর থেকে বের হওয়া হরমোন মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে অনেক প্রভাব ফেলে। এই গ্রন্থির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এসব সমস্যার চিকিৎসায় নিউক্লিয়ার মেডিসিনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছ।
আজ ২২ ফেব্রুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩০৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মিজানুল হাসান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড এলাইড সায়েন্সের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : নিউক্লিয়ার মেডিসিনের সাহায্যে অনেক রোগ নির্ণয় করা এবং চিকিৎসা করা সম্ভব। তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেই চিকিৎসাটি আপনারা করে থাকেন, সেটি হলো, থাইরয়েডের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায়। বিশেষ করে থাইরয়েড ক্যানসারে। শুরুতে একটু বলেন থাইরয়েড গ্রন্থি কী? এর কাজ কী?
উত্তর : আমাদের গলার সামনের দিকে অনেকটা প্রজাপতির মতো একটি ছোট্ট অঙ্গ থাকে। যেটা স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু এই ছোট্ট গ্রন্থিটি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখান থেকে যে হরমোন নিঃসরণ হয়, সেটি শরীরের শারীরিক এবং মানসিক দুটোর বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক। কোনো কারণে যদি এই গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কাজেই আমি বলব, শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থির সম্বন্ধে আমাদের সবারই অত্যন্ত সচেতন হওয়া দরকার এবং একে রোগ মুক্ত রাখার চেষ্টা করা দরকার। urgentPhoto
প্রশ্ন : সাধারণত ডিজঅর্ডার মানে আমরা বুঝি এর কার্যক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটা। কী কী ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে?
উত্তর : গ্রন্থিটি এত ছোট যে আমরা দেখতে পাই না। তবে যদি কখনো কোনো কারণে এই গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করে, তখন অনেক সময় দেখা যায় এর বৃদ্ধি ঘটে। যাকে আমরা গলগণ্ড বলি বা ইংরেজিতে গয়েটার বলি। এক সময় গলগণ্ডের একটি প্রধান কারণ ছিল আয়োডিনের ঘাটতি। তবে এখন বাজারে আয়োডিনযুক্ত লবণ পাওয়া যায় এবং এই লবণ যেহেতু সবাই ব্যবহার করছে বর্তমানে এই আয়োডিনের ঘাটতিজনিত অভাব অনেকটা কমে গেছে। যার কারণে আজ থেকে ২০ বছর আগে আমরা যেভাবে গলগণ্ড দেখতাম, এখন সেটা অনেক কমে গেছে। এখন আর বড় গলগণ্ড দেখতে পাওয়া যায় না। তারপরও আছে। এখনো রোগটি নির্মূল হয়েছে সে কথা বলব না।
এই গ্রন্থির যদি বৃদ্ধি ঘটে সেটি এক ধরনের সমস্যা। যাকে আমরা গলগণ্ড বলছি। তবে এই ফুলে যাওয়ার পর যদি গ্রন্থিটি ঠিকমতো কাজ না করে, এর হরমোন নিঃসরণ যদি কমে যায়, তাহলে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। যদি হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, তাহলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেবে। কাজেই দুটোই সমস্যার। একটু উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, যে আমরা ডায়াবেটিস সম্বন্ধে সবাই জানি। সুগার বেড়ে গেলে যেমন ডায়াবেটিস, তেমনি সুগার কমে গেলেও সমস্যা। থাইরয়েডের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি, হরমোন বেড়ে গেলে এক ধরনের সমস্যা। হরমোন কমে গেলে আরেক ধরনের সমস্যা।
প্রশ্ন : হাইপো (কমা) বা হাইপার (বাড়া) যাই হোক এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার মেডিসিনের কোনো ভূমিকা আছে কী?
উত্তর : একটি রোগী আমার কাছে যখন থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে আসে, তখন সে কি হাইপো, না কি হাইপারের কিছু লক্ষণ দেখে নির্ণয় করি। হাইপার বা হাইপোকে নিশ্চিত করার জন্য নিউক্লিয়ার মেডিসিনে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে। যার মধ্যে থাইরয়েড আপটেক, থাইরয়েড স্ক্যান এবং হরমোন পরীক্ষার জন্য রয়েছে রেডিও ইমিউনো এসেস। এসব পরীক্ষা কিন্তু যেকোনো বেসরকারি গবেষণাগারেও হয়ে থাকে। তবে আমরা যেই পদ্ধতিতে এই হরমোনগুলোর পরীক্ষা করে থাকি, সেটি হলো রিডিউ ইমিউনো এসেস। এখানে আমরা তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকি। এটি আমাদের অত্যন্ত সঠিক মাত্রায় হরমোনের পরিমাণ দেয় এবং সঠিক প্রতিবেদন দিতে সক্ষম হই।
প্রশ্ন : চিকিৎসার বেলায় এর ভূমিকা কী আছে?
উত্তর : যদি হাইপো হয়, তাহলে নিউক্লিয়ার মেডিসিনে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। রোগ নির্ণয় করে থাইরক্সিন রিপ্লেসমেন্ট দেই। অথবা তাকে আমরা এন্ড্রোক্রাইন বিভাগে পাঠাই। তবে যদি সে হাইপার হয় তাহলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রেডিওএকটিভ আয়োডিনের একটি উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে অনেক সময় ১৮ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত চিকিৎসা করতে হয়। এটি লম্বা সময়। তবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ রেডিও আইসোটপ দিয়ে চিকিৎসা করলে, একটি মাত্র ডোজে সে স্বাভাবিক হতে পারে। এটি একটি বড় সুবিধা।
প্রশ্ন : থাইরয়েড ক্যানসার চিকিৎসার বেলায় নিউক্লিয়ার মেডিসিন বা রেডিওআইসোটোপের ভূমিকা কী?
উত্তর : থাইরয়েড ক্যানসারের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত নিউক্লিয়ার মেডিসিনের কোনো বিকল্প নেই। যদি কোনো রোগী থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হন, যেহেতু এটা ক্যানসার তাকে প্রথমত সার্জারি করে যতটা সম্ভব ফেলে দিতে হবে। তবে সার্জারি করে কখনো সম্পূর্ণ কোষ ফেলে দেওয়া বা ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব নয়। কিছু কোষ রয়ে যায় যেখানে নতুন করে ক্যানসার হতে পারে। এই যে অল্প কিছু ক্যানসারের কোষ রয়ে যায়, সেগুলোকে ধ্বংস করার জন্য আমরা আবার রেডিওএকটিভ আয়োডিন রোগীকে দেই। দিলে বাকি যে কোষ এগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আশা করা যায়, সে ক্যানসার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
প্রশ্ন : তেজস্ক্রিয়তা শব্দটি শুনলে আমাদের মধ্যে একটি ভয় কাজ করে। এটি যেমন ধ্বংসের কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি আবার মানব সেবায় ব্যবহার করছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে তেজস্ক্রিয়তা আপনারা ব্যবহার করছেন এর কী কোনো ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে?
উত্তর : আমি এক কথায় বলব যে, এতে ভয় পাওয়া কিছু নেই্। কারণ, যেকোনো রোগীকেই তেজস্ক্রিয় পদার্থ দেওয়ার আগে আমরা সেটা পরিমাপ করি যে কোন রোগীকে কতটুকু দেওয়া যাবে। আমরা ততটুকুই দেব যেটা তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। এই তেজস্ক্রিয়তা মানুষের উপকারই করবে ক্ষতি করবে না।