হেপাটাইটিস বি কীভাবে ছড়ায়

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে অনেকেই আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে উদ্বিগ্ন না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এম এ সাত্তার সরকার। বর্তমানে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩১০তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : হেপাটাইটিস মানে কী? হেপাটাইটিস হয় কী কী ভাইরাস দিয়ে?
উত্তর : হেপাটাইটিস লিভারের (যকৃৎ) একটি অসুখ। লিভারের প্রদাহজনিত সমস্যা এটি। এর নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো হেপাটাইটিস ভাইরাস।
প্রশ্ন : কী কী ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়?
উত্তর : হেপাটাইটিস ভাইরাস সাধারণত পাঁচ রকম হয়। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস।
প্রশ্ন : এই ভাইরাসগুলোর যেকোনো একটিতে আক্রান্ত হলেই হেপাটাইটিস হতে পারে? এর মধ্যে গুরুতর বা জটিল আকার ধারণ করে কোন কোন ভাইরাস?
উত্তর : এই পাঁচ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি-এই দুটো যদি কারো হয়, তার ক্ষেত্রে, ক্ষেত্রবিশেষ উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। তবে সবাই যেভাবে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে যায় সেটি ঠিক নয়।
প্রশ্ন : তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ কী আর উদ্বিগ্ন হলে সঠিক নয় কেন?
উত্তর : আসলে আমরা দৈনন্দিন প্র্যাকটিসে হেপাটাইটিস বি পজিটিভের অনেক রোগী পাই। বেশির ভাগ রোগী আমাদের কাছে এইচবিএসএজি পজিটিভ নিয়ে আসে। এটি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখবেন সাইনবোর্ড ও ক্যানভাস হচ্ছে যে আমরা বি ভাইরাসের চিকিৎসা করি। অন্যান্য অসুখের কারণে চিকিৎসকের কাছে রোগীরা গেলে হয়তো কিছু রুটিন পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে অনেকে এইচবিএসএজি পরীক্ষা করতে দেন। এটি পজিটিভ হলে রোগীদের মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি দল।urgentPhoto
আর যারা বিদেশে যাচ্ছেন, আমাদের দেশ থেকে ওই ব্যক্তিরাও অনেক সময় আমাদের কাছে এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আসেন। আমি যেটা বলতে চাই যে, এইচবিএসএজি পজিটিভ হলে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এর ইতিহাস নিতে হবে, বিষয়টি কতদিনের, ছয় মাসের বেশি নাকি কম- এগুলো জানতে হবে। এখন কোনো লক্ষণ রয়েছে কি না দেখতে হবে। ওই সব লক্ষণ দেখে আমরা বলব আপনি চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করেন। অযথা উদ্বিগ্ন হয়ে টাকা-পয়সা নষ্ট করার দরকার নেই।
প্রশ্ন : একজন মানুষ হেপাটাইটিস বি দ্বারা কীভাবে আক্রান্ত হতে পারেন?
উত্তর : হেপাটাইটিস বি আমাদের দেশে যেভাবে ছড়ায় এর মধ্যে আমাদের বেশি হলো ইনজেকশনের মাধ্যমে, যারা মাদক নেয়। এরা একই সুঁই অনেকে বা বারবার ব্যবহার করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে হয়। তবে এটি এখন অনেক কমে গেছে। বাবা মায়ের থাকলে বাচ্চার হতে পারে। বিশেষ করে মায়ের থাকলে বাচ্চার হতে পারে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের মাধ্যমে হতে পারে। শরীরে ট্যাটু করার মাধ্যমে হতে পারে। সার্জিক্যাল বিষয়ের মাধ্যমেও হতে পারে এবং যৌনমিলনের ফলেও সংক্রমিত হতে পারে।
প্রশ্ন : এইচিআইভি যেভাবে ছড়াতে পারে প্রায় সেভাবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস বি-র লক্ষণ কতদিন পর দেখা দিতে পারে?
উত্তর : এইচবিএসএজি পজিটিভ অথবা হেপাটাইটিস পজিটিভ নিয়ে রোগী চিকিৎসকের কাছে এলো, তখন চিকিৎসক হিসেবে আমাদের করণীয় হলো, রোগীর ইতিহাস ভালো করে নেওয়া। এখন তার জন্ডিস আছে কি নেই, এটি চিকিৎসক দেখলেই বুঝতে পারবেন। তার আগে কোনো প্রতিবেদন পজিটিভ ছিল কি না, অন্যান্য প্রতিবেদন সঙ্গে আছে কি না, পাশাপাশি পেটে পানি আছে কি না, পায়ে পানি আছে কি না এসব আমরা দেখি। আরো কিছু লক্ষণ দেখলে বোঝা যায় এই রোগীর কোনো জটিল লক্ষণ আছে কি না।
৯০ ভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ছয় মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। মানে ছয় মাসের মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াই এটি নেগেটিভ হয়ে যায়, শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে এটি ঘটে।
এ জন্য আমরা বলি, আপনি ছয় মাস অপেক্ষা করেন, এরপর আবার এই পরীক্ষা করেন। যদি পজিটিভ থাকেন, তখন আমরা আলোচনা করব কী করা যায় এই বিষয়ে। তার অন্য কোনো খারাপ অসুখ আছে কি না সেটি তখন খুঁজব।
প্রশ্ন : যদি লক্ষণ দেখা দেয় বা ছয় মাসের মধ্যে এটি ভালো হলো না, সেই ক্ষেত্রে করণীয় কী?
উত্তর : তখন রোগীকে আমরা তার রোগ সম্বন্ধে এবং রোগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানাই। হেপাটাইটিস বি যদি ক্রনিক হয় বা দীর্ঘদিন থাকে, তাদের লিভার সিরোসিস হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে লিভার ক্যানসার হয়। এসব রোগের লক্ষণ আছে কি না চিকিৎসক বলবেন। পাশাপাশি এই জীবাণু তার শরীরে অন্যান্য কোনো ক্ষতি করছে কি না, বংশ বৃদ্ধি করছে কি না, আমরা দু-একটি পরীক্ষা দিয়ে এটা বুঝতে পারি। এবং লিভারের কার্যক্ষমতা কেমন তারও কিছু পরীক্ষা দিয়ে বুঝতে পারি। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। অনেকেই চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন : হেপাটাটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পরিপূর্ণভাবে নিরাময়ের সম্ভাবনা কতখানি? কারো কারো ক্ষেত্রে নিরাময় না ও হতে পারে এমন ঘটে কি না? এবং এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন হয় কি না?
উত্তর : এর চিকিৎসা সাধারণত দুই রকম। মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন। মুখে খাওয়ার যেসব ওষুধ রয়েছে সেগুলো আমরা কিছু পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত দিই। দেওয়ার পর আমরা আবার তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। অনেকেরই নেগেটিভ হয়ে যায় বা ভালো হয়ে যায়। যদি নেগেটিভ না হয় এদের চিকিৎসা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে আরো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তবে তার দীর্ঘমেয়াদি ফলোআপ বা চিকিৎসকের কাছে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : রোগটি কি পরিপূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য?
উত্তর : অধিকাংশ রোগী যদি চিকিৎসা সঠিকভাবে নেয়, তাহলে পরিপূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়। তবে কিছু রোগী রয়েছে, যাদের এটি নেগেটিভ হয় না। তবে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তারা যদি নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে ফলোআপে আসে, তাহলে তার জটিলতা কম হয়।
প্রশ্ন : এ রকম হেপাটাইটিস হলে তার লক্ষণ হিসেবে কারো কারো জন্ডিস দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে নানা রকম প্রচারণা দেখা যায় যে ‘এই রোগের চিকিৎসা করিয়া থাকি’। পাতা ঝাড়ফুঁক এ রকম প্রলোভন দেখানো হয় ভালো করার জন্য। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? এটি কি আদৌ সম্ভব?
উত্তর : এটি জনগুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। আমরা চেম্বারে ও হাসপাতালে এসব রোগী পাই। অনেক রোগীই, যারা কম বয়সী, দেখা যায়, বিভিন্ন রকম গাছগাছরা বা হারবাল ওষুধ খেয়ে আমাদের কাছে চলে আসে। সে এগুলো না খেলে কিন্তু ভালো থাকত। এ জন্য আমরা বলি যদি কারো হেপাটাইটিস বি বা জন্ডিস হয়, আপনি সরাসরি চিকিৎসকের কাছে চলে আসেন। চিকিৎসক আপনাকে ভালো পরামর্শ দেবে। আর জটিলতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাঁরা ঝাড়ফুঁক দিচ্ছেন, যাঁরা এসব ওষুধ বিক্রি করছেন, তাঁরা নিজেরাও জন্ডিস হলে কিন্তু চিকিৎসকের কাছে চলে আসেন। আমি গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাচ্ছি, জন্ডিসের রোগী বা হেপাটাইটিস বি-র রোগী রাস্তার পাশ থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না। এটি অনেক ক্ষতিকর।
প্রশ্ন : এ রকম রোগে আক্রান্ত হলে যদি সঠিক চিকিৎসা না নেয় এটি কতটা গুরুতর হতে পারে?
উত্তর : আসলে সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যানসার হতে পারে। এ দুটো রোগ কিন্তু পুরোপুরি ভালো হবে না। অনেকেরই মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই আগেভাগেই গুরুত্ব দিতে হবে। তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।