মায়ের বয়স বেশি হলে ডাউন সিনড্রমের আশঙ্কা থাকে শিশুর
আজ ২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রম দিবস। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ফেরদৌস মহল রুনী। বর্তমানে তিনি উত্তরা আধুনিক মেডিকেলের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৩৩তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছে।
প্রশ্ন : ডাউন সিনড্রম বলতে আসলে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আসলে এটি একটি বংশগত রোগ। আমাদের দুটো বিষয় রয়েছে অটোজম ও সেক্স ক্রমোজোম। সেই হিসেবে একজন সাধারণ মানুষের অটোজম থাকে ৪৬টি এক্স এক্স অথবা এক্স ওয়াই। এই ক্ষেত্রে ২১ অটোজোমের মধ্যে ট্রান্সলুকেশন হয়ে এটি ৪৬ এক্স এক্স হতে পারে বা এক্স ওয়াই হতে পারে, যোগ ২১ সেই হিসেবে এটি একটি বংশগত রোগ। যদিও এটি এ দেশে খুবই কম। পাশ্চাত্য দেশে দেখা যায় যে, প্রতি সাতটিতে একটি শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্মায়। তবে বাংলাদেশ ও এর আশপাশের পরিসংখ্যানের ডাটা দেখলে দেখা যায়, প্রতি ৬০০ জনের মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
প্রশ্ন : একটি শিশু কী কারণে ডাউন সিড্রম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে? এর পেছনে কি কোনো ঝুঁকি কাজ করে?
উত্তর : আসলে আমরা যদি দেখি ক্রমোজোমাল যে অস্বাভাবিকতাগুলো আছে, আসলে আগেভাগে যে গর্ভপাত হয়ে যায়, তার ৫০ ভাগই ক্রমোজমাল ট্রাইজমের জন্য হয়। তবে আসলে দেখা গেছে ২৫ বছরের আগে যে মায়েরা গর্ভধারণ করে, তাদের বেলায় দেখা যায় এক হাজার ৫০০ জনের মধ্যে একজনের ডাউন সিনড্রম শিশু হয়। তবে ৪৫ বছরের ওপরে মায়ের বয়স হলে শিশু অধিকাংশ সময় ডাউন সিনড্রম নিয়ে হয়। কাজেই এখানে বয়স একটি বিষয়।urgentPhoto
প্রশ্ন : সাধারণত কী দেখলে বোঝা যাবে একটি শিশুর ডাউন সিনড্রম রয়েছে?
উত্তর : ধরে নিলাম, একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে। জন্মের পর বাচ্চার বৈশিষ্ট্য একটি মঙ্গলীয়ান শিশুর যে ধরনের থাকে, এর মাথা ও মুখের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা হয়। এসব শিশুর কানটা নিচের দিকে থাকবে, চোখ দুটো ছোট থাকবে। তার জিহ্বাটা লম্বা, চেহারাটা খুব ছোটো- এই ধরনের কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে এটি ডাউন শিশু।
নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্যারিওটাইপিং করলে দেখা যাবে তার ৪৭ এক্স এক্স বা এক্স ওয়াই। অথবা তার সঙ্গে টুয়েনটি ওয়ান ট্রান্সলুকেশন। তার মানে এটি একটি অটোজোমাল রোগ। কাজেই কেরিওটাইপিং করে আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারি।
প্রশ্ন : এই শিশুটি যখন মায়ের গর্ভে ছিল, তখনই বোঝার কোনো উপায় আছে কি না শিশুটি ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্ম নিচ্ছে?
উত্তর : যদি দেখি একটি মা চল্লিশের পরে, পয়তাল্লিশের দিকে গর্ভধারণ করেছে, তাহলে আজকাল আমাদের কিছু কিছু পরীক্ষা একদম করতেই হয়। সেটি হলো জেনেটিক স্ক্রিনিং টেস্ট। একটি হতে পারে মায়ের আলাফা ফিটো প্রোটিনের মাত্রাটা আমরা দেখি। এরপর দেখতে পারি সেরাম এস বিটা এসের মাত্রাটা কী? এর সাথে হরমোনের মাত্রা দেখি। এই তিনটি দিয়ে আজকাল আমরা মোটামুটি ধারণা করতে পারি, মায়ের ডাউনস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরপর যদি ১৫ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে মাকে এমনিওসিনথেসিস করি, আজকাল এটা সহজেই করা যেতে পারে, ওখানে যদি বাচ্চার ত্বক নিয়ে আমরা কালচার করি তাহলে ক্যারিওটাইপিং বের করা যায়।
প্রশ্ন : ৪৫ বছরের ওপরে যাঁরা মা হন, তাঁদের কী আপনারা এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : হ্যাঁ, এই পরামর্শ আমরা দেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি একটু ব্যয়বহুল পরীক্ষা। সবাই যে করতে পারে সেটা না। কারণ আমাদের পরামর্শটা এই বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে যে বাচ্চা হবে তার বিষয়ে বলে দেই। আজকাল আমাদের মায়েরা অনেক সচেতন। তারা এসে জানতে চায় আমি যে এই বয়সে বাচ্চাটা নিতে চাচ্ছি, তার কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আছে কি না। আমি কী জানতে পাবো বাচ্চাটা আমার ঠিক আছে কি না। কাজেই সেসব ক্ষেত্রে আমরা তাদের ক্ষেত্রে নিয়মমাফিক এই জিনিসটি করে থাকি।
প্রশ্ন : অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এটি জানলে কী লাভ হবে?
উত্তর : প্রথম কথা হচ্ছে এই শিশুটি মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে। তাহলে তার পরিবারের লোকজন এটিকে কতটুকু মেনে নেবে? তা ছাড়া দেখা যায় যে এই বাচ্চাটা যদি বেঁচেও থাকে কিছু সময় পর্যন্ত, যদি গুরুতর ভাবে মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়, তখন শিশুটি মারাও যেতে পারে। দুই নম্বর হলো যদি সে সুস্থও থাকে পরবর্তীকালে তার ফুসফুসে কিছু সমস্যা। কিডনিতে কিছু সমস্যা, কিছু তার লিউকেমিয়া, রক্তের ক্যানসার, হৃদপিণ্ডে সমস্যা, গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গ আছে যেখানে তার এই সমস্যা হতে পারে। তাহলে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। বাবা-মা একটু প্রস্তুত থাকবে এজন্য একটু যত্ন দরকার এবং যদি তাদের আমরা যথার্থভাবে যত্ন নিতে পারি, তখন অনেক ঠিক করা যেতে পারে।
প্রশ্ন : ডাউন সিনড্রমের শিশু যদি হয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মায়েদের প্রতি একটি দোষ দেওয়া হয়। আসলে বিষয়টি কতখানি যৌক্তিক?
উত্তর : এই জায়গায় মাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কারণ মা এর জন্য দায়ী নয়। তবে বয়সের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তাই আমরা বলি বাচ্চা নেওয়ার একটি সুন্দর সময় হলো ২০ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে পরিবারটা সম্পন্ন করে ফেলা উচিত। মায়ের বয়সের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। তবে মায়ের অসচেতনতা এর জন্য দায়ী নয়।
প্রশ্ন : সামাজিকভাবে ডাউন সিনড্রমের শিশুরা অবহেলিত থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন তো দেওয়াই হয় না, তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। এই বিষয়ে আপনি কী পরমর্শ দেবেন?
উত্তর : ধরে নেন, গতকালই আমার কাছে একজন রোগী এসেছে। তার বয়স পয়তাল্লিশের ওপরে, তবে তার আগে একটি বাচ্চা রয়েছে ১৪ বছরের। আমি বললাম, কেন এত দিন নিলেন না। তখন বলল, ম্যাডাম এত দিন চিন্তা করি নাই। তবে এখন দেখছি আমার ওই বাচ্চাটি ভীষণ একা এবং আমারও সময় কাটে না। আমি তখন ওই মাকে বলব আপনি চেষ্টা করেন। যেহেতু তার ঋতুস্রাব এখনো ঠিক মতো হচ্ছে, তাহলে হতে পারে। তাহলে সেই ক্ষেত্রে সে হয়তো বলছে, আমার অস্বাভাবিক সন্তানই হোক তারপরও নেব। ওই মা কিন্তু সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত মা। কিন্তু সে বলছে, আমি একটি বাচ্চা চাই।
আমি জানি এই বাচ্চাটির ডাউন সিনড্রম হতে পারে। তাহলে এই বাচ্চটিকে যদি আগে থেকে যত্ন নেওয়া হয়। তাহলে সে স্বাভাবিক একটি বাচ্চার মতো হতে পারে।