কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছেন?
কোষ্ঠকাঠিন্য একটি প্রচলিত সমস্যা। বিভিন্ন কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। অনেক সময় এটি থেকে ক্যানসারও হতে পারে। তবে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে কোষ্ঠকাঠিন্য ঠিক করা যায়।
urgentPhoto
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৩৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. সালমা সুলতানা। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : কোষ্ঠকাঠিন্য শব্দটা শুনতে একটু কঠিন। এর মানে শক্ত পায়খানা হওয়া বা প্রতিদিন পায়খানা না হওয়া। একেই সাধারণত আমরা কোষ্ঠকাঠিন্য বলে জানি।
পায়খানার অভ্যাসটা আসলে সবার একরকম নয়। অনেকের একবার বা দুবার বাউয়েল নড়াচড়া করে। অনেকের দুদিন পর বাউয়েল নড়ে। অনেক দেশে এমনও আছে যে সপ্তাহে একদিনও নড়ে। এটা মানুষের খাদ্যতালিকা বা খাদ্যাভ্যাস আবহাওয়া, জিনগত কারণ- অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করে।
তবে আমাদের দেশে আমরা সাধারণভাবে যে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, সেগুলোতে প্রতিদিন পায়খানা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা যদি না হয় অথবা খুব কঠিন হয়, শক্ত হয়, যেটা রোগীর জন্য সমস্যা তৈরি করে। একেই সাধারণ ভাষায় কোষ্ঠকাঠিন্য বলি।
প্রশ্ন : সাধারণত কী কী কারণে পায়খানা এমন শক্ত হয়?
উত্তর : সচেতন হলে এই রোগটি অনেকটা প্রতিরোধ করা যায়। তবে মূল সমস্যা হলো খাদ্যাভ্যাস। আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস সেখানে যদি আঁশযুক্ত খাবার কম হয়ে যায়, পানির পরিমাণ কম হয়ে যায়, সেই সব ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা তৈরি হয়। এর সঙ্গে যদি কেউ উচ্চ পরিশোধিত খাবার খায়, যেমন শুকনো খাবার খায়, আবার এখন যেটি প্রচলিত অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে- জাংক ফুড খায়, মাংস বেশি খায় (যেটা আমরা ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পাই) -এ থেকে সমস্যা হয়। প্রতিটি পরিবারেই মনে হয় এটি একটি সমস্যা যে শিশুরা মাংস বেশি খাচ্ছে, শাক সবজি এগুলো খাচ্ছে না।
আমাদের ঐতিহ্যগত খাবারগুলো থেকে বেরিয়ে বাচ্চারা অনেক বেশি বার্গার, শুষ্ক খাবার বিশেষ করে মাংস বেশি খাচ্ছে। মুরগির মাংস বা গরুরু মাংস- এগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে।
একটি বাচ্চার খাদ্যাভ্যাস তো আসলে ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠে। দেখা যায়, অনেক তরুণরাও কিন্তু এখন সবজি খাচ্ছেন না। বেশির ভাগই জাংক ফুড খাচ্ছে। এটি একটি বড় কারণ। খাদ্যতালিকার মধ্যে অবশ্যই প্রতিদিন শাক অথবা সবজি থাকতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে।
আরো একটি বিষয় রয়েছে, দেখা যায় যে কিছু মানুষের একটি বিশেষ ধরনের খাবারে পায়খানাটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। একেকজনের একেকটি খাবারে এমন সমস্যা হয়। কারো একটু হয়তো হজমে সমস্যা হচ্ছে। একটু পাতলা পায়খানা হয়ে যায় আবার অনেকের পায়খানা শক্ত হয়ে যায়। কেউ যদি একটু সচেতনভাবে খেয়াল করে, যে এই খাবারটি খেলে ওনার একটু সমস্যা হয় ওটাকে একটু এড়িয়ে যেতে হবে। এটি একটি বড় কারণ।
আরেকটি কারণ রয়েছে। কিছু ওষুধ আমাদের খেতে হয়। আমরা প্রেসক্রাইব করি, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক- এগুলোতেও অনেক সময় পায়খানা শক্ত হয়।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য হলে আর কী কী সমস্যা হয়?
উত্তর : এনাল ফিসার হয় (মলদ্বার ছিঁড়ে রক্ত পড়া)। পায়খানা যখন দীর্ঘমেয়াদি শক্ত হয়, আমাদের একটি প্রবণতা থাকে, ওষুধ খাওয়া। কিছু সিরাপ পাওয়া যায় এগুলো সারাতে। সাধারণভাবে ধারণা হলো, ‘এটি খেলাম নরম হয়ে গেল’। তবে আসলে এটি কিন্তু সমাধান নয়। কারণ, আপনি দেখেন একসময় ওষুধটি বন্ধ করবেন। বন্ধ করলে দেখা যায় আবার শক্ত হয়ে গেল। যখন বারবার এভাবে ছিঁড়ে যেতে থাকে, তখন ছেঁড়া চামড়াটা একটু বেরিয়ে যায়। সেখানে অস্বস্তি হয়।
অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী ঘা থাকতে থাকতে এখানে ফোড়ার মতো হয়। এই ফোড়া অনেক সময় ফেটে গিয়ে ফিস্টুলা হয়ে যায়। জটিলতার দিকে যায়।
আবার যদি দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে সেই ক্ষেত্রে হেমোরয়েড হয়। একে আমরা পাইলস বলেও জানি।
আমাদের মলদ্বারের ভেতরে কিছু, গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত শিরা থাকে। সে গুচ্ছ রক্তশিরা ফুলে ওঠে। সেখান থেকে রক্তপাত হয়। একে আমরা হেমোরয়েড বলছি।
আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘদিন থাকলে কোলন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যকে ছোট করে দেখার উপায় একেবারেই নেই।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : ছোটবেলা থেকেই খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। বড় যিনি হয়ে গিয়েছেন, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদেরও খেয়াল করে দেখতে হবে আমার খাদ্যাভ্যাসটা কেমন। অনেক সময় দেখা যায় যে স্বাভাবিক খাবার খেয়েও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে। তখন আমরা পরামর্শ দিই, ইসবগুলের ভুষি খেতে। এটি প্রধান পরামর্শ। এরপর পায়খানা নরম হয়ে গেল বলে যে খাদ্যাভ্যাসটা ছেড়ে দিতে হবে তা কিন্তু নয়। এটা সব সময় মেনে চলতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে ইসবগুলের ভূসি খুব ভালো প্রাকৃতিক উপাদান।
এ ছাড়া কিছু মেডিকেশন আছে যেগুলো সাময়িকভাবে পায়খানা নরম করে। সেগুলো দিই। কিছু সিনথেটিক আঁশও পাওয়া যায় এখন। এগুলোকে আমরা খাওয়ার পরামর্শ দিই। বাউয়েল অভ্যাসটা পরিবর্তন হতেও সময় লাগে। ওই সময়ের জন্য আমরা পায়খানা নরম করার ওষুধ দিই।
খুব চাপযুক্ত জীবন, অনেক রাত জেগে থাকা, ঘুম ঠিকমতো না হওয়া, পানি বেশি না খাওয়া- এ রকম সমস্যাগুলো থাকলে বের করে সমাধান করলে প্রায় ৯৯ ভাগ রোগী কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে পারে।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য এনাল ফিসার হলে আপনারা এর চিকিৎসা কীভাবে করে থাকেন?
উত্তর : এনাল ফিসারের ক্ষেত্রে প্রথমে আমরা পায়খানা নরম করতে বলি। পায়খানা নরম হলে বেশির ভাগ এনাল ফিসার ঠিক হয়ে যায়। পায়খানা ঠিকমতো হতে থাকলে এটি শুকনো অবস্থায় থাকে। পায়খানা হয়তো একটু শুকানো অবস্থায় থাকে, তবে এতে কোনো সমস্যা হয় না। সারা জীবন কোনো সমস্যা না করেই থাকতে পারে।
তবে এমন যদি হয় কোনো রোগীর ক্ষেত্রে পায়খানা নরম হওয়ার পরও এনাল ফিসারটি নিরাময় হচ্ছে না, ওখানে জ্বালাপোড়া হচ্ছে, বা পায়খানা করতে অসুবিধা হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে আমরা একটি অস্ত্রোপচার করি। খুবই সাধারণ ছোট একটি অস্ত্রোপচার। তবে এতে রোগী ভালো হয়ে যায়। পাশাপাশি তার কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করতে হবে।
আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা আছে যে পায়খানার রাস্তায় অস্ত্রোপচার হলে এটি আর ভালো হয় না। এর কারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য অনেক সময় হয়তো থেকেই যায়। তাই রোগীকে পরামর্শ দেওয়া এখানে খুব জরুরি। মূল কথা হলো খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখতে হবে এবং একে মেনে চলতে হবে।
আরেকটি কথা বলি, একজন মানুষের হয়তো পায়খানা স্বাভাবিকই ছিল। তবে হঠাৎ করে কয়েকদিন কোষ্ঠকাঠিন্য হলো। সবকিছু করার পরও ঠিক হচ্ছে না, হয়েই যাচ্ছে, অথবা কিছুদিন নরম থাকছে আবার কিছুদিন কঠিন হচ্ছে। এটি কিন্তু একটি জটিল অবস্থা। এটি ক্যানসারের একটি লক্ষণ। এ রকম হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।