কোলোরেকটাল ক্যান্সার কী ও কেন হয়?

কোলোরেকটাল বা বৃহদন্ত্রের ক্যানসার সারা বিশ্বেই এখন বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা গেলে রোগ বহুলাংশে ভালো হয়ে যায়। তাই ৪০ বছরের পরে অন্তত একবার কোলোনোস্কোপি বা স্ক্রিনিং করা জরুরি। আজ ২৬ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৮৬ তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কোলোরেকটাল সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম এ এরফান।
প্রশ্ন : কোলোরেকটাল ক্যানসার কী?
উত্তর : আমাদের যে পরিপাকতন্ত্র আছে তার শেষের যে অংশ, যেটাকে বাংলায় বলা হয়, বৃহদন্ত্র সেই অংশটিকে কোলোরেকটাল বলে। উপরের অংশটিকে কোলোন এবং নিচের অংশ যেটা মলাশয়, স্টুল বা মল জমা থাকে সেটাকে বলা হয় রেকটাম। এ দুটি মিলে হলো কোলোরেকটাল। এখানে যে ক্যানসার হয় সেটা কোলোরেকটাল ক্যানসার।
প্রশ্ন : সাধারণত ক্যানসার হওয়ার পেছনে কিছু কারণ কাজ করে। কোলোরেকটাল ক্যানসারের পেছনে কোন কোন বিষয় কাজ করে?
উত্তর : কোলোরেকটাল ক্যানসারের কারণগুলো হচ্ছে, আমাদের বর্তমান সমাজের ফ্লুয়েন্ট লাইফস্টাইল অর্থাৎ আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস সেটাই কারণ হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। আমরা রিফাইন খাবার খাচ্ছি। শাক সবজি বা আশযুক্ত খাবার কম খাচ্ছি। খাবারের কিছু বিষয় ক্যানসারের পূর্ববর্তী উপাদান হিসেবে তৈরি হচ্ছে। এগুলোকেই কোলোরেকটাল ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে।
আরেকটি কারণ হলো কোলোনিক পলিপ, সেখানে এক ধরনের আঙ্গুলের মতো বৃদ্ধি দেখা যায়। সেটা যদি চিকিৎসা করা না হয় সেটা পরবর্তীকালে ক্যানসারে রূপ নেয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা কেমন?
উত্তর : সারা বিশ্বের হিসাবটা বলি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে সেখানে এখন দ্বিতীয় প্রচলিত ক্যানসার এটি। ফুসফুস ক্যানসারের পরই কোলোন ক্যানসার বেশি হয়। আমাদের দেশে এটার এখনো কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমাদের খুব কাছের দেশ সিঙ্গাপুর যেখানে এই সম্বন্ধে ভালো গবেষণা হয়, সেখানে এখন কোলোরেকটাল ক্যানসারের অবস্থান প্রথম। এমন কি ফুসফুসের ক্যানসারও কোলোরেকটাল ক্যানসারের পরে। কারণ আপনারা জানেন, সারা বিশ্বে সিগারেট খাওয়া বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণার কারণে কমে যাচ্ছে। কোলোরেকটাল ক্যানসার বেড়ে যাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস বা এসবের কারণে। ওই হিসেবে দেখলে আমাদের দেশেও এ রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের কাছে প্রচুর রোগী আসছে কোলোরেকটাল ক্যানসার নিয়ে।
প্রশ্ন : কোলোরেকাটাল ক্যানসারের উপসর্গগুলো কী?
উত্তর : সব ক্যানসারের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে এর কোনো লক্ষণ দেখা দেবে না। কোলোনে হলে এক ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পাবে। আর রেকটামে হলে আরেক ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পাবে। কোলোনে হলে, পেট ব্যথা, ক্ষুধা মন্দা, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, পায়খানার অবস্থা পরিবর্তিত হওয়া (অর্থাৎ একবার হয়তো পাতালা পায়খানা হলো। আরেক বার হয়তো কষা পায়খানা হলো)। আগে সে হয়তো নিয়মিত মল ত্যাগ করত, এখন হয়তো অনেকবার করতে হয়। এ ছাড়া কালো পায়খানা হতে পারে।
রেকটাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে সকালে পাতলা পায়খানা হবে। একবার টয়লেটে যাওয়ার পর হয়তো মনে হবে পায়খানা পরিষ্কার হয়নি। আবার যাবে। রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হবে। অথবা মিউকাস এবং রক্ত মিশ্রিত পায়খানা যাবে। এই বিষয়গুলো রেকটাল ক্যানসারে দেখা যায়। এখানে অনেকের ভুল হয় যে এটাকে পাইলস ভেবে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ক্যানসার হয়েছে। কোলোরেকটাল ক্যানসারের এখনো একটা বিষয় রয়ে গেছে, এখনো হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে প্রধান চিকিৎসা হিসেবে রয়ে গেছে এটি। আমাদের মিডিয়া এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিন্তু এখনো আমরা পেছনে আছি। তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো হয়ে যেতে পারত যে রোগী তাকে আমরা পাচ্ছি অনেক পরে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য আমাদের যে বিষয়টি করা দরকার সেটি হলো স্ক্রিনিং টেস্ট।
আমাদের দেশে যে স্ক্রিনিং টেস্ট হয় সেটাকে বলা হয় কোলোনোস্কোপি। একটা লম্বা নল কোলোনে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় সেখানে কোনো পলিপ বা টিউমার আছে কি না। আমাদের দেশে আসলে ৪০ এরপর সবারই কোলোনোস্কোপি করা উচিত। তাহলে আগে থেকে রোগ নির্ণয়ের হার অনেক বেড়ে যাবে।
সিঙ্গাপুরে খুবই ভালো বিষয় হচ্ছে, কোলোনোস্কোপি নিয়মিত করার ফলে ৯০ শতাংশ রোগ নির্ণয় আগাম করা যাচ্ছে। রোগ আগে ধরা পড়লে ৯৫ শতাংশ ভালো হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
আরেকট ভালো বিষয় হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের কোলোন ক্যানসারের খুব চমৎকার চিকিৎসা রয়েছে। অনেক রোগী রয়েছে যারা প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার করার কারণে দীর্ঘ দিন ধরে সুস্থ রয়েছে। যারা শুরুর দিকে চিকিৎসা করেছে তারা ভালো হয়ে গেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে এর একেবারে ভালো হওয়ার চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রপচার।
প্রশ্ন : অনেক সময় রোগীর মধ্যে স্ক্রিনিং বা কোলোনোস্কোপি করার ক্ষেত্রে যে অনীহা বা ভীতি দেখা যায় এদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : ডায়াবেটিস হয়েছে এমন ভেবে আপনি যদি রোগ পরীক্ষা না করান তাহলে আমি বলব যে, আপনার একদিন না একদিন ডায়াবেটিস হবেই। তাই আপনি যদি রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসায় যেতে পারেন তাহলে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। কোলোনোস্কোপি স্ক্রিনিংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি তাই। কোলোনোস্কোপি করে রোগ আগে থেকে নির্ণয় করা হলে সেই রোগ ভালো হয়ে যায়। সেটাকে অপারেশন করে ভালো করা যাবে। আর যেটির লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে সেটা অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বোঝা যাবে কতটা ভালো করা যাচ্ছে। তাই কোলোনোস্কোপি এমন একটি বিষয় যা নিশ্চিত করবে আমি এই রোগ থেকে মুক্ত আছি।