টনসিল ও এডিনয়েডের সমস্যার লক্ষণ কী?
অনেকেরই টনসিল ও এডিনয়েডে সমস্যা হতে দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের সমস্যাগুলো বেশি হয়।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৭৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক খবির উদ্দিন আহম্মেদ। বর্তমানে তিনি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে কর্মরত আছেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : টনসিল ও এডিনয়েড কী? এর কাজ কী?
উত্তর : টনসিল আমাদের গলার দুই পাশে দুটি লিম্ফোয়েড টিস্যু ও এডিনয়েড তালুর ওপরে ফ্যারিংসের নিচে থাকে। দুই দিকে দুটো টনসিল, এডিনয়েড ওপরের দিকে আর জিহ্বার গোড়ায় কিছু এডিনয়েড টিস্যু থাকে। এগুলোর সঙ্গে একটি রিং তৈরি করে। বিশেষ করে, বাচ্চাদের ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত এগুলো রোগ প্রতিরোধ করে থাকে এবং বাইরে থেকে মাছের কাঁটা, জীবাণু, ধুলা আটকে ফেলে। এ জন্য কোনো ক্ষতিকারক বাইরের পদার্থ শ্বাসযন্ত্রে ঢুকতে পারে না। এ ছাড়া শরীরের রোগ প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যেগুলো রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এই দুভাবে এরা মানুষের শরীরকে জীবাণু ও বাইরের পদার্থ থেকে রক্ষা করে থাকে।
প্রশ্ন : টনসিলের সঙ্গে সঙ্গে এডিনয়েডে সমস্যাগুলো কী হয়? এডিনয়েড কোথায় থাকে? এটি কি বাইরে থেকে দেখা যায়?
উত্তর : এডিনয়েড বাইরে থেকে দেখা যায় না। কারণ, আমাদের তালুর ওপরে এডিনয়েড থাকে। কাজেই এটা এমনি দেখার কোনো উপায় নেই। তবে টনসিল হাঁ করলে দেখা যায়। এটা দেখতে হলে এক্স-রে করতে হবে বা বিশেষ ধরনের অ্যান্ড্রোস্কোপ আছে, সেগুলো দিয়ে দেখা যেতে পারে।
প্রশ্ন : তাহলে দুটোর সমস্যাগুলো কী কী হতে পারে?
উত্তর : সাধারণত টনসিলে প্রদাহ বাচ্চাদের হয়। এডিনয়েডের সমস্যা হয় অনেক ছোট বাচ্চাদের। সাধারণত এডিনয়েডের সমস্যা বেশি হয় আড়াই থেকে ছয় বছরের বাচ্চাদের মধ্যে। আড়াই থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত টনসিল বেশি হয়। একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি আগেই বলেছি, এগুলো লিম্ফোয়েড টিস্যু, যখন টনসিল বাড়ে প্রদাহের কারণে, সেই সঙ্গে এডিনয়েডও বেড়ে যায়। টনসিলে প্রদাহ হলে সাধারণত জ্বর হয়, খেতে কষ্ট হয়, প্রচণ্ড গলাব্যথা হয়। পেটব্যথা ও বমি হয়।
আর যদি এডিনয়েড বেড়ে যায়, তাহলে সেই সঙ্গে হাঁ করে নিশ্বাস নেবে। রাতে ঘুমালে আওয়াজ হবে। নাক ডাকার শব্দ হবে। কানে ব্যথা হবে। কানে কম শুনবে। এটা যখন দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তখন ক্রমাগতভাবে মস্তিষ্কে অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়। একে বলে ‘ক্রনিক হাইপোক্সিয়া’। এর জন্য বাচ্চাদের স্মরণশক্তি কমে যায়। স্কুলে যায়। তবে সেখানে ক্রমাগত ফল খারাপ করতে থাকে।
প্রশ্ন : এ জাতীয় সমস্যা আগে থেকে বোঝার উপায় কী?
উত্তর : মা-বাবার করণীয় হলো, যখনই একটি বাচ্চা দেখবে যে বারবার ডাকলে শুনছে না অথবা রাতে হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, শ্বাস নেওয়ার সময় মুখ দিয়ে লালা পড়ছে, আওয়াজ হচ্ছে, আবার রাতে শোয়ার সময় কটমট শব্দ হচ্ছে, উল্টাপাল্টা কথা বলছে, এমনকি ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। হঠাৎ করে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে যাচ্ছে, তবে ফল আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আবার রেডিও, টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তখনই বুঝতে হবে, তার টনসিল ও এডিনয়েডের সমস্যা শুরু হয়েছে। তখনই দেরি না করে কাছের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ যিনি আছেন, সেখানে চেকআপ করাতে হবে। কারণ, এটা প্রথম থেকে ধরা পড়লে স্কুলের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, এগুলো থেকে রক্ষা পায়।
প্রশ্ন : সমস্যাটি গলায় বা তালুতে, সেখান থেকে কানের সমস্যা কেন হয়?
উত্তর : আপনারা জানেন, কানের সঙ্গে গলার একটি সম্পর্ক রয়েছে একটি টিউব দ্বারা। এটা মধ্যকর্ণ থেকে আরম্ভ করে একেবারে মুখের ভেতর পর্যন্ত, তালুর ওপরে চলে যায়। দুদিকে দুটো ইউসটাসেন টিউব রয়েছে। এই টিউব দুটি যেখানে মুখগহ্বরের ভেতরে খোলে, ঠিক সেখানে, দুটো টিউবের মাঝখানে থাকে এডিনয়েড। এডিনয়েড যখন বড় হয়ে যায়, ইউসটাসেন টিউব খোলার সময় চাপ দেয়। চাপ দিয়ে টিউবটিকে বন্ধ করে দেয়। ইউসটাসেন টিউবের কাজ হলো মধ্যকর্ণে বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখা, যাতে মানুষ শুনতে পারে। যখনই এই বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, মধ্যকর্ণের ভেতরে বাতাস শুকিয়ে যায়। এতে নেগেটিভ (ঋণাত্মক) চাপ তৈরি হয়। এটি সৃষ্টি হলে বাচ্চারা আর কানে শুনতে পায় না, কানে ব্যথা হয় এবং এটা দীর্ঘদিন থাকলে কানের ভেতর ফ্লুইড (তরল) জমা হয়। ফ্লুইড জমা হয়ে কানে সংক্রমণ হয় এবং কম শুনতে থাকে। এতে স্কুলের পারফরম্যান্স খারাপ করতে থাকে।
প্রশ্ন : এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে রোগীরা যখন আসে, তখন কী করেন?
উত্তর : আমাদের কাছে এলে আমরা ভালো করে ইতিহাস নিই যে বাচ্চা ভালো করে শ্বাস নিচ্ছে কি না, স্কুলের ফল খারাপ করছে কি না। রেডিও, টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না। তার গলাব্যথা, জ্বর, কানব্যথা এগুলো বারবার হয় কি না। এ ধরনের হলে আমরা একটি এক্স-রে করি, তালুর। এটি করলেই আমরা বুঝতে পারি ওইখানে এডিনয়েড বেড়েছে। এ রকম হলে আমরা কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিই। অ্যান্টিবায়োটিক দিই, নাকের ড্রপ দিই, অ্যান্টিহিসটামিন দিই। এগুলো দিলে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যাদের এডিনয়েড বড় হয়ে চরম পর্যায়ে চলে যায়, সেগুলো আর ভালো হয় না। যখন আমরা দেখি ওষুধে ভালো হচ্ছে না, তখন যত দ্রুত সম্ভব আমরা এডিনয়েড ফেলে দিই। এডিনয়েড ফেলার সময় যদি দেখি টনসিল অনেক বড়, তখন টনসিল একসঙ্গে ফেলে দিই। কারণ, টনসিল বাড়লে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছোট বাচ্চাদের এডিনয়েডও বেড়ে যায়। কাজেই দুটোই ফেলে দিতে হবে। একটি রেখে আরেকটি যদি ফেলে দিই, তাহলে কিন্তু তার সমস্যা সমাধান হবে না। তাই দুটোকে একসঙ্গে ফেলতে হবে, যাতে করে বাচ্চার হাইপোক্সিয়া বন্ধ হয়। স্কুলের পারফরম্যান্স ভালো করে। কানে ভালো শোনে। কারণ, আপনারা ভালো করে জানেন যে কানে কম শুনলে তার মানসিক বৃদ্ধি ভালোভাবে হবে না।
প্রশ্ন : টনসিল বা এডিনয়েডের সমস্যা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর : অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি, আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং অ্যালার্জি থাকলে এর চিকিৎসা করতে হবে। মেঝেতে বেশি শোয়া যাবে না। এতে ঠান্ডা লাগতে পারে। আর যে ঘরে থাকে, সেখানে যেন বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ভালো থাকে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত ভিড়ও এসব সমস্যার একটি কারণ। দেখা যায়, অনেক বাচ্চা একসঙ্গে থাকে। একটু ভিড় থেকে যদি দূরে থাকা যায় এবং বায়ুর চলাচল যদি ভালোমতো করানো যায়, তাহলে এডিনয়েডর ও টনসিলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়।