বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস : তামাককে না বলুন
ধূমপান না করলে নাকি পৌরষত্বের প্রমাণ হয় না। তাই তো আগের দিনে বিয়ের বয়স হতে না হতেই পারিবারিকভাবে পাওয়া হুক্কায় টান দিত কিশোররা। আধুনিককালে স্মার্ট হওয়ার জন্যও করা হয় ধূমপান। কিন্তু স্মার্টনেসের সংজ্ঞা এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধূমপান না করাটাই এখন স্মার্টনেস। কারণ, ধূমপান যে পরিমাণ স্বস্থ্যের ক্ষতি করে, তা কোনো স্মাট ছেলেমেয়ে করতে পারে না।
শুধু ধূমপানের কারণেই আয়ুষ্কাল কমে যায় ১০-২০ বছর। কী, অবাক হলেন? বিশ্বাস করতে পাচ্ছেন না? তাহলে পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। বিশ্বে যত লোক মারা যায়, তার দ্বিতীয় প্রধান কারণ ধূমপান। প্রতিবছর ৫৮ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় ধূমপানের কারণে, প্রতি ১০ জনে একজন। মৃতদের শতকরা ৭০ ভাগই কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এর অবস্থা দাঁড়াবে ছয়জনের মধ্যে একজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর এক কোটি লোক ধূমপানের কারণে অসুস্থ হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ধূমপানের কারণে বিংশ শতাব্দীতে যে পরিমাণ লোক মারা গেছে, একবিংশ শতাব্দীতে তার ১০ গুণ মারা যাবে। সিগারেটের একটা টানে তিন হাজারের অধিক রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধূমপায়ীর শরীরে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিকোটিন। এই নিকোটিনই ধূমপান ছাড়তে দেয় না।
বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের আড়াই কোটিই ধূমপায়ী। জর্দা, সাদা পাতা, গুল হিসাবে আনলে এ সংখ্যা চার কোটি ১৩ লাখ। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে তামাক সেবন কমছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক সেবন ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে প্রতিবছর বাড়ছে। ধূমপানের কারণে আকালেই ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ।
ধূমপান ও ক্যানসার
চিকিৎসকদের বইয়ের প্রতিটি রোগের কারণ হিসেবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধূমপানের কথা লেখা আছে। কাজেই বোঝা যায় কেমন মারাত্মক এটি। তবে ক্যানসারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ধূমপান জড়িত। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ ভাগ ক্যানসারের কারণ ধূমপান। ধূমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ফুসফুসের ক্যানসার। প্রতিবছর বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যানসারে। এ ক্যানসারের শতকরা ৯০ ভাগ কারণ ধূমপান। এ কারণে হতে পারে মুখ, গলা, গলবিল, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, মূত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসার। গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ১০ গুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালি, অগ্ন্যাশয়, কিডনি, মূত্রথলি, জরায়ুমুখ ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বেশ কয়েক গুণ বেশি।
ধূমপান ও হৃদরোগ
ধূমপান করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরল ও খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমে যায় ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে করে রক্তনালিতে চর্বি জমে গিয়ে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের ৪০ বছরের পর হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা পাঁচ গুণ বাড়ে। হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ।
ধূমপান ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ
ধূমপায়ীরা ২০-৩০ বছর পর শ্বাসকষ্টের রোগে আক্রান্ত হন। মারাত্মক ধরনের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এমনকি হাসপাতালে ভর্তিও থাকতে হয়। শ্বাসকষ্টের এ রোগটির নাম সিওপিডি। যাঁদের পরিবারে এ রোগে আক্রান্ত আছেন, কেবল তাঁরাই জানেন এর যন্ত্রণা। শুধু ধূমপান বন্ধ করলেই এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
শ্বাসনালির সংক্রমণও বাড়ায় ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা দুই থেকে চার গুণ বেশি। প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয় এরা। এ ছাড়া ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়।
ধূমপান ও গর্ভস্থ শিশু
ধূমপানের ফলে মায়ের পেটের শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে অ্যাবরশন হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বাচ্চার ওজন কম হতে পারে, আক্রান্ত হতে পারে অ্যাজমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু মা-বাবার ধূমপানে আমেরিকার দুই থেকে তিন লাখ শিশু শ্বাসনালির প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ১৫ হাজার হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই মারা যেতে পারে শিশু।
অনেকে শিশুদের দিয়ে সিগারেট-বিড়ি কিনে নিয়ে আসেন। এতে করে শিশুদের মধ্যে সিগারেটের প্রতি আগ্রহ জন্মে। বড় হয়ে তারাও ঝুঁকে পড়ে সিগারেটের দিকে। কাজেই এটা একেবারেই করবেন না।
সেকেন্ডহ্যান্ড বা পরোক্ষ ধূমপান বেশি ক্ষতিকর
আশপাশের ধূমপায়ীদের ধোঁয়া ক্ষতি করে চলেছে আপনার অগোচরে। একে বলে সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিং। গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসের ক্যানসারের ১০ শতাংশ রোগী কখনই ধূমপান করেননি। এরা আক্রান্ত হয়েছেন সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিং থেকে। এ ছাড়া এদের ক্ষেত্রে ক্যানসারের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ। তাই আপনার আশপাশের ধূমপায়ী হতে সাবধান হোন।
বাসায় ধূমপান একেবারেই করবেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপনার শিশু। ঘন ঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
ধূমপান ও মাদক
যেকোনো নেশা শুরু হয় ধূমপান দিয়ে, শেষ হয় মাদকতায়। এটা গবেষণা করেই বলেছেন বিজ্ঞানীরা। ধূমপায়ীরা খুব সহজেই অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্রুত মাদক নিতে শুরু করে। আমরা বর্তমানে মাদক নিয়ে বেশ সচেতন। কিন্তু এর প্রবেশদ্বার বন্ধ করতে রাজি নই। অনেকে কৌতূহলের বশে বন্ধুদের সঙ্গে মেশার সময় সিগারেটে এক-দুই টান দেয়। বন্ধুরাও জোরাজুরি করে। কৌতূহলের বশে এক টানই কিন্তু আপনাকে নিয়ে যাবে মাদকের জগতে। তাই সাবধান! যারা সিগারেট টানতে বলে, তারা কিন্তু ভালো বন্ধু নয়।
সিগারেট ও দুশ্চিন্তা মুক্তি
ধূমপায়ীরা কেন ধূমপান করেন—জানতে চাইলে বলেন, এটি নাকি তাদের দুশ্চিন্তা কমায়। এটি ধূমপান জায়েজ করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। দুশ্চিন্তা কমে ধূমপানে, এমন কোনো গবেষণালব্ধ ফল জানা যায় না। উল্টো ধূমপানে শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়। এটি টেনশন বা অবসাদ আরো বাড়ায়।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।