মৃগীরোগে কী কী সমস্যা হতে পারে

এপিলেপসি বা মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। তবে চিকিৎসা রয়েছে এ রোগের। এই রোগ নিয়েও ভালোভাবে জীবনযাপন সম্ভব। আজ ১ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০২২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান।
প্রশ্ন : এপিলেপসি বা মৃগীরোগ বলতে আসলে কী বোঝায়?
উত্তর : এটা মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। হঠাৎ করে মস্তিষ্কে যে কোষগুলো আছে, সেখান থেকে বিদ্যুতের মতো চমকাতে থাকে। সেটা অস্বাভাবিক এবং বেশি পরিমাণে হয়। এর একটি প্রকাশ শরীরে হতে থাকে। যেমন হঠাৎ করে খিঁচুনি হয় বা কাঁপুনি হতে থাকে। অথবা হাত পা শক্ত হয়ে যায়। চোখ উল্টে যায়, মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে যায়। অথবা এমনও হতে পারে, হঠাৎ করে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, হাতে কোনো কিছু ছিল- সেটা পড়ে গেল। মুখ দিয়ে ফেনার মতো আসতে থাকল। এমনকি পায়খানা-প্রস্রাবও হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : এর কারণগুলো কী কী?
উত্তর : বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মস্তিষ্কের কোনো একটা সংক্রমণ হলে; সেটার জটিলতা হিসেবে এটি প্রকাশ পায়। অথবা দেখা যায় বাচ্চাদের জন্মের সময় মাথায় কোনো আঘাত পেলে, তখন অক্সিজেন পেতে দেরি হলে মস্তিষ্কের সমস্যা হয়। অথবা যদি বাচ্চা কম ওজনের হয় বা যে তারিখে জন্মের সময় ছিল তার আগেই যদি জন্ম হয়ে যায়, তাদেরও কখনো কখনো এপিলেপসি হতে দেখা যায়। আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয় যেমন, ইলেকট্রোলাইট যেগুলো আছে, হঠাৎ করে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হলে গ্লুকোজ কমে যায়, তারই জটিলতা হিসেবে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথবা মাথায় কোনো আঘাত পেলে এই সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্কে টিউমার হলে এই সমস্যা হতে পারে। আসলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণই জানা যায় না। কিছুটা বংশগত কারণেও হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুকাল থেকেই কি লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, নাকি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এসেও হতে পারে?
উত্তর : প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় হতে পারে। এ ছাড়া শিশুরা যারা এই সমস্যায় ভুগছে, তারাও একসময় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়।
প্রশ্ন : এই জাতীয় সমস্যা যার হবে তখন তাৎক্ষণিকভাবে কী করণীয়?
উত্তর : নিরাপদ জায়গায় তাকে রাখতে হবে। আরামদায়ক অবস্থায় শুইয়ে দিতে হবে। কাত করে শুইয়ে দিতে হবে বা উপুড় করে শুইয়ে দিতে হবে। দুই হাত দুই দিকে দিয়ে মাথাটাকে একদিকে দিয়ে শুইয়ে দিতে হবে, যাতে মুখের সমস্ত লালা বাইরে পড়ে যেতে পারে। কাছাকাছি আগুন, গরম পানি, ধারালো কিছু থাকলে এগুলো সরিয়ে নিতে হবে, তখন হাত-পা ছোড়াছুড়ির ফলে এগুলো যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। মুখে কিছু দেওয়া যাবে না এই সময়টায়। অনেক সময় তাদের দাঁত বা জিহ্ববা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তখন আমরা মুখে চামচ দিই, পানি দিই- এগুলো এই সময় দেওয়া যাবে না। অনেক সময় চেপে ধরি যেন খিঁচুনি না হয়, এগুলো করা যাবে না। এগুলোতে আরো তাদের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি হৈ চৈ না করা উচিত। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
প্রশ্ন : এমন রোগীরা যখন আপনাদের কাছে যাচ্ছেন, তখন প্রাথমিকভাবে কী করেন?
উত্তর : আমরা প্রথমত পায়খানার রাস্তায় একটি ইনজেকশন দিই। এটা দিলে তৎক্ষণাৎ খিঁচুনি কমে যায়। এটাতে না কমলে তখন শিরায় আইভি ইনজেকশন দিই। বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন দিয়ে প্রথমে আমরা খিঁচুনিটা কমানোর চেষ্টা করি। তারপর যখন খিঁচুনিটা কমে যায়, তখন আমরা ইতিহাস খতিয়ে দেখি-কেন এটা হলো খুঁজে বের করে কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করি। এর পাশাপাশি হাসপাতালে যখন ভর্তির সময়, তখন খেয়াল রাখতে হবে তার পালস, রক্তচাপ যেন ঠিক থাকে, শ্বাসপ্রশ্বাস যেন ঠিকভাবে চলাচল করে।
প্রশ্ন : কয়েকদিন পরপরই যদি এই সমস্যা হতে থাকে এটি থেকে কী কী ধরনের জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : এটি মস্তিষ্কের একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। স্বভাবতই এটি মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা তৈরি করতে পারে। মস্তিষ্কের বিকাশ সুন্দরভাবে হয় না। কথা বলতে সমস্যা হয়। তাদের বুদ্ধির বিকাশে সমস্যা হয়। কথা তৈরিতে সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : এপিলেপসির চিকিৎসা কি রোগীকে সারা জীবন নিতে হয়, নাকি নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত নিলে সে সুস্থ হয়ে যেতে পারে?
উত্তর : সাধারণত শেষ যেদিন খিঁচুনি হলো এই সময় থেকে তাকে দুই থেকে তিন বছর ওষুধ খেতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে যদি বড় কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে ওই সমস্যাটা থেকেই যাবে। যেমন কোনো একটা স্ট্রোকে পড়তে পারে। বাচ্চাদেরও স্ট্রোক হয়। বা কোনো একটি ট্রমা বা টিউমার থেকে এই সমস্যা হলো, তখন মস্তিষ্কের সমস্যা থেকেই যাবে। এর ফলে সব সময় তার খিঁচুনির সমস্যা থাকবে। কিছু কিছু মারাত্মক ধরনের এপিলেপসি আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে সারা জীবনই ওষুধ খেতে হয়। সাধারণত দুই থেকে তিন বছরের ওষুধ দিয়ে থাকি, যদি খিঁচুনি না হয়। এরপর ধীরে ধীরে ওষুধ বন্ধ করে দিই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সারা জীবনই খেতে হয়। এটা চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন যে কতদিন খেতে হবে।
প্রশ্ন : আমরা দেখি মৃগীরোগীদের সামাজিকভাবে যথেষ্ট হেয় করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আপনি কী বলবেন? এবং কী পরামর্শ থাকবে সেসব মানুষের প্রতি, যাঁরা এই মানসিকতা পোষণ করেন? আর এ ধরনের রোগীও বেশ গুটিয়ে থাকেন এবং কারো কাছে প্রকাশ করতে চান না যে তার এই রোগ রয়েছে–আপনার পরামর্শ কী এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : সমাজে বোঝাতে হবে এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ না বা মানসিক রোগ না। এটি এমনও না যে পাগল হয়ে গেছে। এর নিরামায়যোগ্য চিকিৎসা আছে। এ পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ব্যক্তিদের মধ্যেও এই রোগ ছিল। যেমন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট, জুলিয়াস সিজার- এদের মৃগীরোগ ছিল। আর দশটা সাধারণ রোগের মতো এটিও একটি রোগ এবং এর চিকিৎসা রয়েছে। এটি নিয়েও বেড়ে ওঠা যায়, সব কিছু করা যায়।