অবাঞ্ছিত লোম, কী করবেন?

অনেকের শরীরে অবাঞ্ছিত লোম দেখা যায়। এর কিছু কারণ রয়েছে। এর ভালোমতো চিকিৎসা করা সম্ভব। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪৯৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন। বর্তমানে তিনি শিওর সেল মেডিকেল বিডির পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : অবাঞ্ছিত লোম বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আনওয়ানডেট হেয়ার মানে আমরা এই চুলটি চাই না। মেয়েদের কখন আনওয়ানটেড হেয়ার হয়? মেয়েদের শরীরের চুল সুন্দর আর মসৃণ হয়। একে আমরা বলি পিট বাস। তবে এই চুলটি যখন পুরুষের মতো হয়, টেক্চারটি আলাদা হয়ে যায়।তখনই আমরা আনওয়ানটেড হেয়ার বলি। এর মূল শিকার মেয়েরা যদি বেশি পরিমাণে হয়।
প্রশ্ন : এর পেছনের কারণ কী?
উত্তর : যেহেতু ছেলেদের মতো চুল তাই, ছেলে হরমোন বেড়ে যায়। টেস্টেসটোরেন হরমোন মূল সমস্যা। এটি যদি স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বেশি হয়ে যায়, তখনই আনওয়ানটেড হেয়ার হয়।
আমরা বলি চুলের ডেসটিবিউশনটা হচ্ছে জেনেটিক মেকআপ। আমার চুলের বিষয়টি কেমন হবে এটি জিনগতভাবে নির্ধারিত। এরপরে আরো কিছু রোগ আছে। মেয়েদের আরেকটি যেই সমস্যা হয় পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রম। পিসিওএস বলি। এরপরে আছে কুশিং সিনড্রম। কিছু ওষুধের কারণে হয় বেনাজল, স্টেরয়েড।
প্রশ্ন : যার এই সমস্যা থাকে সে বুঝবে কীভাবে যে তার আসলে এই সমস্যাটি হয়েছে?
উত্তর : পিসিওএস থেকে শুরু করি।শিশুজন্মদানের সময়ে, তাদের অনিয়মিত মাসিক হয়। ডিম্বাশয়ে অনেক সিস্ট থাকে। এর সাথে ব্রণ হয়, চুল কমে যায়। চুল পড়তে থাকে। এই সব লক্ষণ যখন একসাথে দেখা দেয়, একে আমরা পিসিওএস বলি। এরপরও অবাঞ্ছিত চুল হলো যেখানে আমরা চুল চাচ্ছি না, সেসব জায়গায় চুল হচ্ছে। আর আমাদের যেখানে দরকার সেখানে চুল থাকছে না। সাথে সাথে আমাদের কিছু লক্ষণ আছে, সেগুলোকে আমরা ভিরেলাইজেশন বলি। মেয়েদের স্তনের আকার কমে যায়। জেনিটেল ক্লাইটোরিসের আকার বড় হয়ে যায়। এই সমস্যাগুলো থাকলে আমরা একে আনওয়ানটেড হেয়ারের লক্ষণ বলে থাকি।
প্রশ্ন : আমাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা প্রকাশ করতে চায় না। যেহেতু সামাজিকভাবে হোক বা ধর্মীয় কারণে হোক, যেকোনো কারণেই তারা এটি প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আমি অবাঞ্ছিত লোম নিয়ে অনেক সেমিনার করেছি। এর মধ্যে আমি টাঙ্গাইলের একটি থানায় গিয়েছিলাম। সেখানে একজন মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল, সে সারা মুখ ঢেকে ছিল। কেবল চোখটা তার বের করা। আমি বললাম, এখানে তো আমরা সবাই মেয়ে আছি। কেন সে এত লজ্জা পাচ্ছে?
পরে খুলে দেখলাম তার ছেলেদের দাড়ির মতো মুখে লোম। সে খুব বিষণ্ণ ছিল, কারণ তার বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের আগে সে রেজার দিয়ে সেভ করেছিল।বিয়ের পর যখন সে শ্বশুরবাড়ি যায় তার তো এই অবঞ্চিত লোমগুলো অনেক প্রকাশ পেয়ে যায়। তাকে শুশ্বরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। খুবই দুঃখের একটি বিষয়। এই যে জিনিসগুলো আমি দেখছি, আমার প্রথম উপদেশ হবে যেহেতু চাইল্ড বেয়ারিং বয়সে মেয়েদের এটি হয়, আমার প্রথম উপদেশ হবে, মেয়েরা যখন ছোট থাকে তখন অভিভাবককে সচেতন হতে হবে।
যদি মায়ের আনওয়ানটেড হেয়ার থাকে তবে মেয়ের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তার অবাঞ্ছিত লোমগুলো দেখা যাচ্ছে কি না। সে যেন সেভ করে সেটিকে ঢাকার চেষ্টা না করে। ১২-১৩ বছর বয়স থেকে এটি শুরু হতে থাকে।
আর আমরা তো হরমোনের পরীক্ষার মাধ্যমে জানতেই পারি, আল্ট্রাসাউন্ড করতে পারি। তাহলে সিস্টগুলো বোঝা যাবে। সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করে এডিনাল গ্রন্থিতে কোনো টিউমার আছে কি না, সেটা দেখতে পারি।
প্রশ্ন : কখন যাওয়া উচিত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে?
উত্তর : যখন আমরা অবাঞ্ছিত লোমগুলো বের করতে পারব, শুরুতেই এর চিকিৎসা করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আসবে তত তাড়াতাড়ি রেহাই পাবে।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের ব্যবস্থা আপনারা নিয়ে থাকেন এই অবাঞ্ছিত লোমগুলো সরানোর ক্ষেত্রে?
উত্তর : প্রথমেই আসছে সেল্ফ কেয়ার। নিজেকে ভালোবাসা নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া। দেখতে হবে আমার অবাঞ্ছিত লোম হচ্ছে কি না। একসময় কনভেনশনাল থেরাপিতে হেয়ার রিমুভাল ক্রিম ব্যবহার করতাম। এখন তো বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি রয়েছে। ইলেকট্রোলাইসিস নামে একটি থেরাপি আছে, ইলেকট্রোলাইসিস থেরাপিতে আমরা নিডেল পাস করি। অবঞ্চিত লোমের ফলিকলে ডেসট্রাকশন করি। এগুলো শুধু একটি চিকিৎসা পদ্ধতিতে হয় না। সাথে মুখে খাওয়ার ওষুধও লাগবে। আমরা যদি হেয়ার লেজার রিমুভালও নেই, সাথে ওরাল মেডিকেশন লাগবে।
কারণ, আমাদের যে হরমোনটি অবাঞ্ছিত লোম তৈরি করছে, তাকে আমাকে ব্লক করতে হবে। এরপর হেয়ার ফলিকলকে ডেসট্রাকশন করতে হবে। দুইভাবে কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন : আরেক ধরনের সমস্যা রয়েছে যে অবাঞ্ছিত লোমগুলো থাকে সেগুলো খুব বড় আকারে থাকে। এর মাত্রাটা ধীরে ধীরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এটি আসলে কী ধরনের সমস্যা?
উত্তর : এটি ছেলে বা মেয়ের সবারই হতে পারে। একে আমরা হাইপারট্রাইপোসিস বলি। স্বাভাবিক বয়স বা লিঙ্গের হিসেবে হাত-পায়ের লোমগুলো বা মুখের লোমগুলো বেড়ে যেতে পারে। এটা হাইপার ট্রাইকোসিস।
প্রশ্ন : এই রোগের ক্ষেত্রেও কি চিকিৎসা পদ্ধতি একই রকমের?
উত্তর : চিকিৎসা পদ্ধতি একই। হেয়ার লেজার রিমুভাল। আর এর সাথে আমরা হরমোনাল থেরাপি দিয়ে থাকি। তবে এগুলোর কারণ একটু ভিন্ন। এটা কনজেনিটাল হতে পারে এবং অ্যাকুয়ার্ডও হতে পারে। কনজেনিটালটা দুই রকম। আমাদের জন্মের সময় যে চুলগুলো থাকে, একে আমরা বলি ভেলেস হেয়ার। চুলে ভ্রুতে টারমিনাল হেয়ার হয়ে যায়। এই ভেলেস হেয়ারটি যখন টারমিনাল হেয়ারে কনভার্ট হতে থাকে, একে আমরা বলি কনজেনিটাল টার্মিনাল একুইজিটা।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন যে জন্মগত বা বংশগতভাবে এটি হয়ে থাকে, আরো কিছু কারণ বলেছিলেন যে একোয়ার্ড মানে পরিবেশ থেকে যেটা আমরা পাই। এই কারণগুলো আসলে কী?
উত্তর : এটি আসলে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।একটি হলো লোকালাইজড আরেকটি হলো জেনারালাইজড। জেনারালাইজড যেটা হয় সেটা হলো এনারেক্সান এরহোসা। অনেকে কিন্তু খেতে চায় না। এটা অনেক সময় অভ্যাসে পরিণত হয়। এদের হরমোন ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। তখন আনওয়ানটেড হাইপার ট্রাইকোসিস দেখা যায়। ক্যানসারের ক্যামোথেরাপির পর এই রকম সমস্যা হতে পারে। আর কিছু কিছু ওষুধের কারণে হয়। সিস্টেমিক স্টেরয়েড। আবার অনেকে আমরা ফর্সা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করি। তখন এ রকম মুখে লোম তৈরি হয়। তাই পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সতর্ক হতে হবে।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কী কী ধরনের পরামর্শ রয়েছে?
উত্তর : হাইপার ট্রাইকোসিস প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো, যেহেতু কারণ থেকে হয়, আমাদের স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েট মেনে চলতে হবে। ক্র্যাশ ডয়েটে যাওয়া যাবে না। আমি সকালের খাবার বাদ দেব না। পাঁচবেলা খাব। সকালে খাব, মিড মরনিং (মধ্যম সকালে) স্ন্যাকস খাব, দুপুরের খাবার খাব। বিকেলে স্ন্যাকস খাব। রাতের খাবার খাব। তবে সেটা ভারাসাম্য পূর্ণ হতে হবে। চিনি কম খাব। প্রোটিন, ভালো চর্বি খাব। আর আর্দ্রতা তো বজায় রাখতেই হবে।