বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস
আর নয় আত্মহত্যা, হোক জীবনের জয়গান
আত্মহত্যা অথবা আত্মহনন যে নামেই বলি এটি অমূল্য জীবনের অপচয়। আত্মহত্যা সম্পন্ন হয়ে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না। এ জন্য আত্মহত্যা প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর উপায়। আত্মহত্যার বেদনাদায়ক প্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির জীবননাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্টজন, পরিবার ও সমাজে এক ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসে। এ জন্য, আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এ বছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ ২০১৬ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য-‘Connect, Communicate, Care’। অর্থাৎ ‘সম্পৃক্ত হোন, যোগাযোগ করুন, যত্ন নিন।’
বিশ্বস্ব্যাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন (প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন)। আমাদের দেশে আত্মহত্যার জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন স্থানীয় গবেষণায় দেখা যায়, এ হার প্রতি লাখে ১০ জন। এটি উন্নত দেশের কাছাকাছি। প্রতিটি আত্মহত্যার আগে গড়ে ২৫ বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর এ অসংখ্য জীবনহানি প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা, দ্রুত ও সময়মতো আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ণয় এবং তার প্রতিকার।
যে বিষয়টি আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে সেটি হচ্ছে আত্মহত্যা এবং এর প্রবণতার সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগের নিবিড় সম্পর্ক। আত্মহত্যার এক গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের শতকরা ৯০ ভাগের যেকোনো ধরনের মানসিক রোগের সমস্যা ছিল। এর মধ্যে বিষণ্ণতা, স্কিটজোফ্রিনিয়া নামক জটিল মানসিক রোগসহ মাদকাসক্তি ও এলকোহলে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, শারীরিক কারণে মানসিক সমস্যা যেমন, মৃগীরোগ অন্যতম। অথচ এসব মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসা আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান। অসচেতনতা, অজ্ঞতা, লোকলজ্জা ও সামাজিক নিগ্রহের ভয় এবং সর্বোপরি মানসিক রোগ চিকিৎসায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এসব ব্যক্তি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যে মানসিক রোগ তার নাম বিষণ্ণতা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সবকিছু (নিজের, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে। সবসময় মনে করে যে এ অবস্থা থেকে তার পরিত্রাণ নেই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায় আমাদের দেশে বিষণ্ণতার হার ৪ দশমিক ৬ ভাগ। সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের দ্বিগুণ এবং বিষণ্ণতার হার আগের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানসিক চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আনতে পারলে এদের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের বিষণ্ণতায় মস্তিষ্কের রাসায়নিকের তারতম্য দেখা যায়, যে কারণে ওষুধের প্রয়োজন হয়। মৃদু ও মাঝারি ধরনের বিষণ্ণতায় সাইকোথেরাপি বেশ কার্যকর। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ও মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতায় এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতার সাথে ব্যক্তিত্বের সমস্যা অনেকাংশে দায়ী। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অপ্রাপ্তি, অসহ্য মানসিক চাপ, মানসিক ও যৌন হয়রানি, সহিংসতা, যৌতুকের চাপ, পরকীয়া ও দাম্পত্যকলহ প্রভৃতি থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষয়টির সাথে মানসিক চাপ মোকাবিলার দক্ষতার অভাব এবং ব্যক্তিত্বের ভঙ্গুরতা সম্পর্কযুক্ত। তার ওপর যখন শেষ আশ্রয়স্থল ঘনিষ্ঠনজন ও পরিবারের নিকট থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় তখন ব্যক্তি আত্মহত্যা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না। এ জন্য মানসিক চাপ মোকাবিলার দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা অর্জন আত্মহত্যা প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারীর সবসময় নিজেকে মেরে ফেলার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। আবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় অসফল ব্যক্তি তার ইচ্ছের কথা গোপন করতে পারে। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে সবসময় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এর মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ ও সমস্যা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী সময়মতো চিকিৎসা প্রদান করলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মিডিয়ার দায়িত্বহীন প্রতিবেদনকে অনেক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী দায়ী করে থাকেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিভিতে আত্মহত্যার দৃশ্য ও সংবাদ প্রকাশের ১০ দিন পর্যন্ত আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। ১৭৭৮ সালে জার্মান ঔপন্যাসিক গ্যাটের ‘Sorrows of Young Werther’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মহত্যার হার বেড়ে যায় যেজন্য বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এ ঘটনা থেকে ‘Werther Effect’ শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ - আত্মহত্যার ছবি ও পদ্ধতি অনুকরণ বা অনুসরণ করে আত্মহত্যা (Copy Cat) । এ জন্য মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে আরো সতর্কতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে যেটি অনুসরণ করায় হংকংয়ে আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে নাটকীয়তা পরিহার, আত্মহত্যার সংবাদ হেডলাইন ও কাভার পেজে না ছাপা, আত্মহত্যার ছবি পরিহার, বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মহত্যার খবর মৃত্যু সংবাদ হিসেবে দেওয়া, মানসিক ও শারীরিক কারণে আত্মহত্যা করে থাকলে সেটি উল্লেখ করা ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের উচিত এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সাংবাদিকতার নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, যা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কীটনাশক ব্যবহার করে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। এ জন্য কীটনাশক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধি এবং কীটনাশকের বিষাক্ততার মাত্রা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। শ্রীলংকায় কীটনাশকের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ১৯৯৫-২০০৫ দশকে আত্মহত্যার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা আমরাও কাজে লাগাতে পারি।
আত্মহত্যা সম্পন্ন হয়ে গেলে যেহেতু কিছুই আর করার থাকে না সেহেতু এ জন্য প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর পন্থা। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সময় এখনই। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা আত্মহত্যা প্রতিরোধে অন্যতম ভূমিকা রাখে। এজন্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি চালু করা এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্য খাতের আগামী পাঁচ বছরের মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধকে গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখা, তাদের কথা মনোযোগের সঙ্গে শোনা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। লোকলজ্জা ও সামাজিক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পারলে অমূল্য জীবনের অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা যেখানে মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক- ‘আর নয় আত্মহত্যা, হোক জীবনের জয়গান।’
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ,
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।