স্বাভাবিক প্রসব কখন হয়

সন্তান নেওয়ার বিষয় এলে অনেকেরই মাথায় আসে প্রসব স্বাভাবিক হবে, না কি সিজার হবে। প্রসবের এই বিষয়গুলো নির্ভর করে মা ও গর্ভের শিশুর অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। আজ ৩ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০২৪ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের পরামর্শক ডা. ফারজানা ডালিয়া।
প্রশ্ন : যখনই সন্তান প্রসবের বিষয়টি আসে তখনই মাথায় আসে এটি সিজার হবে না স্বাভাবিক হবে? আরো একটি বিষয় আছে, মানুষ মনে করে, গাইনির চিকিৎসকদের কাছে গেলে তাদের সিজার করার দিকেই ঝোঁক থাকে। একজন মায়ের সন্তান প্রসবের সময় কী কী বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এটি ঠিক করেন প্রসব স্বাভাবিক হবে না কি সিজার হবে?
উত্তর : যখন একজন মা গর্ভবতী হন তখন প্রথমই তার মাথায় চিন্তা আসে প্রসবটা কীভাবে হবে। স্বাভাবিক প্রসব হওয়ানোর ক্ষেত্রে আমরা দেখি মা ও বাচ্চা উভয় সুস্থ আছে কি না। কোনো ধরনের জটিলতা যেন না থাকে। বাচ্চার অবস্থা যেন ঠিক থাকে। মার যেই পথটা দিয়ে প্রসব হবে সেটি যেন প্রশস্ত হয়। আর যখন তার প্রসবের সময়টা এগিয়ে আসে তখন যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যথা থাকে এবং জরায়ুর মুখটাও যথাযথভাবে খোলে। এসব বিষয় যদি ঠিকঠাক মতো থাকে তখন অবশ্যই স্বাভাবিক প্রসব হবে। তখন আমরা স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে থাকি।
আর সিজারের কথা যখন আসে তখন যেটা বললেন, অনেকেরই গাইনোকোলোজিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে। তবে সব সময় সেটা হয় না। যখন সিজারের প্রয়োজন পড়ে তখনই করে থাকি। আর সিজারিয়ান সেকশন বর্তমানে বেড়ে গেছে; তার কারণ আমাদের উন্নত প্রযুক্তির কারণে আগে ভাগেই বুঝতে পারি মায়ের ভেতরে যে শিশুটি রয়েছে সে অক্সিজেন পরিবহন কী রকম পাচ্ছে। যদি সমস্যা হয় তখন অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচারে যেতে হবে আমাদের।
অনেক সময় আমরা দেখি শিশুটিা হয়তো মায়ের দেহে ঠিকভাবে বাড়ছে না। সেই ক্ষেত্রেও করতে হয়। ইদানীং দেখা যায় নারীরা একটু বেশি বয়সে সন্তান নিচ্ছে। কারণ সবাই পড়াশোনাটা শেষ করে সন্তান নিতে চায়। চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। বয়স হয়ে গেলে মাদের নানা রকমের ঝুঁকি হয়ে যায়। তখন উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন গর্ভধারণ বলি। সেই ক্ষেত্রে দেখা যায়, তখন আমাদের সিজারিয়ান সেকশনটা করতে হচ্ছে। আর অনেক ক্ষেত্রে মায়েরাও স্বাভবিক প্রসবের ঝুঁকি নিতে চান না। সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় সিজারিয়ানের হারটা বেড়ে গেছে। তবে সাধারণত যদি শিশুর কোনো সমস্যা হয়, জটিলতা যদি মা বা শিশু দুজনেরই থাকে, যদি ফুলটা নিচের দিকে থাকে, যদি রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে- এধরনের সমস্যায় আমরা সিজারিয়ান সেকশন করে থাকি।
প্রশ্ন : সন্তান প্রসবের বিষয়টি অনেক ব্যথাদায়ক- সে জন্য অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে চান যে তাঁর সিজারিয়ান ডেলিভারি হোক। সে রকম ইচ্ছা যদি প্রকাশ করেন তাহলে কী আপনারা মায়ের ওই ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন। নাকি পরামর্শ দেন। স্বাভাবিক প্রসব হয় কি না সেই চেষ্টাটিও করেন?
উত্তর : এটা আসলে অবসটিশিয়ানদের ওপরে নির্ভর করে। তবে আমরা সবসময় পরামর্শ দেই, মাকে বোঝাই স্বাভাবিক প্রসবই ভালো। কারণ একদিনের মধ্যেই তুমি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে যেতে পারছ। আর অস্ত্রোপচার হলে সেখানে তিন দিন বা চার দিন থাকতে হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অনেক বেশি। অস্ত্রোপচারে অনেক ঝামেলা। অনেকভাবেই তাঁকে আমরা বোঝাতে চাই। প্রথমে যখন অ্যান্টিনেটাল চেকআপ করি তখন থেকেই আমরা এসব ব্যাপরে পরামর্শ দেওয়া শুরু করি। স্বাভাবিক প্রসব ভালো। প্রচণ্ড ব্যথা হবে, তবে এটি কিছু সময়ের জন্য। কিছু ব্যথা নাশক ওষুধও আছে এখন সেগুলোও ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন : স্বাভাবিক প্রসব হাসপাতালে করানো সম্ভব। মায়েদের হয়তো পরামর্শ দেওয়া হলো তারপরও সে দোদুল্যমান। আপনার ওপরই ছেড়ে দিল বিষয়টি। তখন কোনটিকে গুরুত্ব দেন?
উত্তর : আচ্ছা, সেই ক্ষেত্রে আমরা যখন দেখি পরামর্শ দিয়ে কোনোভাবেই কিছু করা যাচ্ছে না, তখন সিজার করার পরামর্শ দেই।
প্রশ্ন : সিজার নিয়ে আরো কিছু ধারণা আছে, কেউ কেউ মনে করেন যে সিজারিয়ান শিশুদের মেধা কমবেশি হয়, অসুখ বা রোগ-ব্যাধি বেশি হবে কি না- এসব বিষয়ও আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আসলে অনেক ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে মানুষের ভেতর। কারণ তারা ভাবে যে স্বাভাবিক প্রসবের শিশুটি অনেক কষ্ট করে বের হয়েছে। সে জন্য তার অসুখ-বিসুখ কম হবে, সে মেধা সম্পন্ন হবে। আর যেহেতু সিজারিয়ান শিশুটি অনেক আরামে বের হয়েছে, পেট কেটে বের করে ফেলছি অনায়াসে- তাই তার মধ্যে জিনিসগুলো কম হবে। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, শিশুটি যখন গর্ভাবস্থায় থাকে তখন সে কিন্তু জানে না তার স্বাভাবিক প্রসব হবে, না কি সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে তাকে বের করা হবে। তার বুদ্ধিমত্তা পেটের ভেতর থেকেই্ তৈরি হচ্ছে, সেটা একই রকম হচ্ছে। এটাতে কোনো পার্থক্য আসলে হয় না।
প্রশ্ন : কিন্তু যদি এমন হয় অপরিপক্ব শিশু জন্ম দিতে হলো সিজারিয়ানের মাধ্যমে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সেই ক্ষেত্রে আরেকটি পরিপূর্ণ শিশু স্বাভাবিক প্রসব হলো- এদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?
উত্তর : অপরিপক্ব শিশুকে যদি আমরা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে প্রসব করাই সেটা স্বাভাবিক প্রসবের থেকে ভালো। কেননা অপরিপক্ব শিশুর মাথাটি সেইভাবে গঠিত থাকে না। সে যখন স্বাভাবিক প্রসবের পথ দিয়ে বের হতে চায়, তখন আঘাত প্রাপ্ত হয়। তখন তার বুদ্ধিমত্তা কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর অপরিপক্ব শিশুকে যখন আমরা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বের করি সেই ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক প্রসবের পরবর্তী জটিলতা থেকে সে ভালো থাকে। কারণ সেক্ষেত্রে তার আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা কম। ৩৭ সপ্তাহ হয়ে গেলে আমরা পরিপক্ব বলি। আর তার থেকে একটু আগেও যদি করি, ৩৪ সপ্তাহ থেকে তখনো সে ধরনের কোনো সমস্যা পাওয়া যায় না। দুটো শিশু একই রকম হয়ে থাকে। প্রথম দিকে হয়তো বা তাদের শ্বাসকষ্ট বা কোনো ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। পরাবর্তীকালে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে কেউ কোনো অংশে কম থাকে না।
প্রশ্ন : সিজারিয়ান সেকশনের পর অনেক মায়ের একটি ভাবনার বিষয় হয় পেটে দাগ থাকা। এ ক্ষেত্রে অনেকেই এসে আবদার করেন কসমেটিক স্টিচ দিতে হবে। এই বিষয়টি কী? আসলে এই দাগ থাকে কি না? সেটি দূর করার জন্য কী করেন?
উত্তর : এই সেলাইয়ের বিষয়ে, আর দাগের বিষয়ে মায়েরা খুব সচেতন। এটি নিয়ে তারা খুব চিন্তিত থাকেন। আসলে এটি নির্ভর করে শরীরের ওপর। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় অস্ত্রোপচারের তিন মাস পরে কারো কোনো দাগই থাকে না। হালকা একটা দাগ হয়তো বা সরু সুতার মতো বোঝা যায়। এটা আসলে নির্ভর করে আমরা সেলাইয়ে যে জিনিসগুলো ব্যবহার করছি সেটা তার শরীর কীভাবে নিচ্ছে। এটাতে আসলে কারোরই হাত নেই। তবে দাগ যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের লোশন আছে সেগুলো দিয়ে থাকি। অলিভ ওয়েল আছে ব্যবহারের জন্য সেগুলো দিয়ে থাকি।
প্রশ্ন : একজন মায়ের হয়তো স্বাভাবিক প্রসব হলো, আরেকজনের সিজারিয়ান প্রসব, বলবেন কী এই দুজনের মধ্যে হাসপাতালে থাকার সময় এবং পরিবর্তী সময়ে জীবনযাত্রার ধরনের কোনো পার্থক্য হয় কি না?
উত্তর : অবশ্যই একটু পার্থক্য করতে হয়। কেননা স্বাভাবিক প্রসবের পর একদিন হাসপাতালে থেকে সে চলে যেতে পারছে। তবে সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে তো তার তিন থেকে চার দিন থাকতে হয়। যদি সব ঠিকঠাক থাকে। তারপর সিজারিয়ান সেকশনে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ অনেক কিছু কেটে আমাকে ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে তাই সংক্রমণ হয়ে গেলে হাসপাতালে অনেক দিন থাকতে হবে। আর স্বাভাবিক প্রসবে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
আর কাজ করার ক্ষেত্রে মা পরের দিন গিয়েই কাজ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিজারিয়ান প্রসবে মা এত কাজ করতে পারে না। ভারি কাজগুলো আমরা বলি যে দেড় মাস পরে করার জন্য। কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। তবে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রেও মায়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এটি খুব কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। তার অনেক শক্তিহানি ঘটে। তাকে হয়তো একদিন পরই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে তাই বলে তাকে পরের দিন গিয়েই বাসায় কাজ করতে হবে এটি ঠিক নয়। তাকেও বিশ্রামে রাখতে হবে।