নারীর অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাবের কারণ ও করণীয়
বিভিন্ন কারণে নারীদের প্রস্রাবে অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ হয়। এটি রোধে সচেতন থাকা জরুরি। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৪৯তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. হাসিনা আফরোজ। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চতর এমএস এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : প্রস্রাবে অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ কাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে?
উত্তর : বিভিন্ন বয়সে এটি হচ্ছে। প্রসবজনিত সমস্যার কারণে একটি ফিস্টুলা হচ্ছে, এর কারণে সারাক্ষণই প্রস্রাব ঝরে মেয়েদের। গ্রামে অনেক সময় প্রস্রাবের সময় দাইরা বুঝতে পারে না কীভাবে প্রসব করাবে। এতে শিশুর মাথা হাড়ের মধ্যে আটকে যায় এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে সেখানে একটি পচন ধরে। এরপর দেখা যায়, বাচ্চা পেটেই মারা যায়। অনেক কষ্ট করে হয়তো বেরিয়ে যায় বাচ্চাটা। তখন মেয়েদের ওই জায়গাটি পচন ধরে পুরো ছিঁড়ে যায়। এটা অনেক জটিল একটি অবস্থা। প্রসব হতে গিয়ে যেখানে সুন্দর একটি পরিবার পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে সে সব কিছুই হারিয়ে ফেলে। মৃত শিশু হয়তো প্রসব করে। আবার দেখা যাচ্ছে তার স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। সব সময় তার গায়ে থেকে হয়তো প্রস্রাব ঝরছে, তার পাশাপাশিও কেউ বসতে চায় না। শেষ পর্যন্ত তাকে হয়তো যেতে হয় বাবার বাড়িতে। সেখানেও সে হয়তো কোনো কাজ করতে পারে না। তার জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তার জীবনের কোনো রকম মূল্যায়নই যেন থাকে না। এতে তার মন এত ভেঙে যায়, অনেক সময় নিজের মৃত্যুই কামনা করে। স্বাস্থ্যগত সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। এটা একটা সমস্যা।
ফিস্টুলা শুধু সেখানে হয় না, পায়খানার রাস্তাও অনেক সময় ছিঁড়ে যায়। সেটাও অবসট্রাকটিভ লেবারের কারণে ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ হাজার লোক এরকম আছে।
প্রশ্ন : ফিস্টুলা ছাড়া এর কি আর কোনো কারণ রয়েছে?
উত্তর : আমাদের দেশে কিছু সার্জন হচ্ছে পুরো শরীরের সার্জন। তারা হয়তো ছোট ছোট ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে। ইউটেরাস ফেলতে গিয়ে ব্লাডার ফুটো করে ফেলে। এটা থেকেও মধ্য বয়সের লোকদের ফিস্টুলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় ব্লাডার পুড়িয়ে ফেলে। ব্লাডার পুড়িয়ে ফেলে ফিস্টুলা হচ্ছে। এই ধরনের সমস্যা ভালো করার জন্য আমরা অনেক অস্ত্রোপচার করেছি। এবং ভালো হচ্ছে।
প্রশ্ন : এই ক্ষেত্রে কি স্নায়ুজনিত কোনো কারণ আছে?
উত্তর : অন্যান্য কারণগুলো যেগুলো আছে, একে বলে আর্ট ইনকনটিনেন্স। সাধারণত ৪০ বছরের পর এগুলো বেশি হয়। তাদের প্রস্রাবের চাহিদা হতে হতে আর আটকে রাখতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে বাথরুমে যাওয়ার আগেই মনে হয় যে প্রস্রাব হয়ে যাবে। প্রস্রাবের চাপ এলে তারা দৌড় দিয়ে চলে যায়। এটি একটি বড় সমস্যা।
আরেকটি হলো হাঁচি দিলে প্রস্রাব আসে, কাশি দিলে প্রস্রাব আসে, জগিং করলে প্রস্রাব আসে। ছোটখাটো বিষয়েই তার প্রস্রাব চলে আসে। একে বলে স্ট্রেস ইন কনটিনেন্স। এটা অনেক কারণেই হতে পারে। যাদের অনেকক্ষণ প্রস্রাব হয়, প্রসবের সময় সমস্যা হয়, তাদের এই সমস্যা হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটি হরমোন থাকে স্ট্রোজেন হরমোন, মেনোপজ হওয়ার পর সেই হরমোনটা কমে যায়। এতে শরীরের অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ওখানেই সহজেই দুর্ঘটনা ঘটে। আবার স্ট্রোজেনের কারণে তার রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার কারণে, যেটা ধরে রাখতে আগে পারত সেটা সে পারছে না। তাড়াতাড়ি সংক্রমণ হচ্ছে। এটাও একটা বড় কারণ স্ট্রেস ইন কনটিনেন্সের। অনেক সময় দেখা যায় দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস, হয়তো পেলভিক সার্জারি হয়েছে, অথবা তার নিউরোলজিক্যাল কোনো সার্জারি হয়েছে, অথবা অনেকদিন ধরে সে বিছানায় পড়ে আছে। তার নিউরোপ্যাথি বৃদ্ধি পেয়েছে, ডায়াবেটিসের কারণে। এসব কারণে প্রস্রাব জমতে জমতে বুঝতেই পারে না তার চাহিদা হয়েছে।
ব্লাডার ৩০০ থেকে ৬০০ এমএল পর্যন্ত ধরতে পারে। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে হয়তো তারা বুঝতে পারে না যে প্রস্রাব জমে যাচ্ছে। তখন ইউরেথ্রা খুলে গিয়ে চাপ পড়ে এমনি এমনি প্রস্রাব হয়ে যাচ্ছে। একে বলে নিউরোজেনিক ব্লাডার। এটি আসলে একটু কষ্টকর।
প্রশ্ন : কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে কী কী ধরনের চিকিৎসা আপনারা দিয়ে থাকেন?
উত্তর: আমাদের সরকার এখন অ্যান্টিনেটাল কেয়ার, চেকআপ, প্রসব ব্যবস্থাপনা এগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এই জন্য গর্ভাবস্থায় ভালোমতো অ্যান্টিনেটাল কেয়ার প্রয়োজন।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের বিষয়ে একটু বলবেন?
উত্তর : বাচ্চা পেটে এলে নারীদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হবে। একটি স্বাস্থ্যবান মা স্বাস্থ্যবান বাচ্চা উপহার দিতে পারে। এই জন্য মেয়েদের ছোটবেলা থেকে পুষ্টি দিতে হবে। অনেক সময় গ্রামে দেখা যায়, পেটে বেশি বাচ্চা এলে খুব একটা খেতে দেয় না। ওই বাচ্চাটি যখন প্রসব হলো সে কিন্তু অপুষ্টি নিয়েই জন্ম নিল। যখন বাচ্চাটা ছেলে হলো তার প্রতি মনোযোগ অনেক চলে গেল। এই বিষয়গুলো করা যাবে না। মেয়ে ও ছেলেকে সমানভাবে বড় করতে হবে। আর বাল্যবিবাহ অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আর মেয়েদের আমি বলব অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে হবে। সে যদি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রসবের জন্য সে হাসপাতালে যাবে। সুতরাং একটি সম্পূর্ণ অ্যান্টিনেটাল কেয়ার, মেয়েশিশুকে ঠিকভাবে গড়ে তোলা, ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে না দেওয়া, তাকে শিক্ষিত করা, এগুলো হলো অবসট্রাকটিভ ফিস্টুলাকে প্রতিরোধ করার জন্য।
আর সার্জিক্যাল ফিস্টুলা যেটা হচ্ছে, অপ্রশিক্ষিত লোক দিয়ে হচ্ছে, এগুলো প্রতিরোধে প্যালভিক এনাটমি সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে হবে। সঠিক লোকের কাছে পাঠাতে হবে। সেই ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসার দিকে জোর দিতে হবে। ক্লিনিকগুলো পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আজেবাজে জায়গায় গিয়ে কোনো মানুষ যেন ব্ড় বড় অস্ত্রোপচার না করে, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো করতে হবে।

ফিচার ডেস্ক