দেশে প্রতিদিন তামাকজনিত রোগে ৪৪২ জনের মৃত্যু

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ মারা যান। তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনাসহ এসডিজির অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ : বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ বৈঠক হয়। এর আয়োজন করে তামাকবিরোধী দুই সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও আত্মা (অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স)।
গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হয়। যেখানে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত লক্ষ্য ‘৩এ’ অর্জনের জন্য ডব্লিওএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) বাস্তবায়ন সরকারগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে এফসিটিসি স্বাক্ষর করে।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও জানানো হয়, তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতা শুধু এসডিজির তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনেও বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক খরচের ৫ শতাংশ তামাক ব্যবহারে এবং ১০ শতাংশ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তামাক ব্যবহারের স্বাস্থ্য ব্যয় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তামাকের কারণে দরিদ্র মানুষ, আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে, যা এসডিজির দারিদ্র্য নির্মূলসংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা-১ অর্জনে বড় বাধা।
বৈঠকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তামাক চাষে বছরে ব্যবহৃত হয় এক লাখ একরের বেশি জমি, যা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির (লক্ষ্যমাত্রা-২) জন্য ক্রমশ হুমকি তৈরি করছে। তামাকপাতা পোড়াতে এবং প্রক্রিয়াজাত করতে উজাড় হচ্ছে দেশের ৩০ শতাংশ বন। বিড়ি এবং জর্দা-গুল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে নারী ও শিশুশ্রম। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশসহ পলিথিনের মোড়ক ও জর্দা-গুলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কৌটা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। এভাবে তামাকের উৎপাদন এবং ব্যবহার টেকসই উন্নয়নের প্রায় সবকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘নারী শিশুসহ অধূমপায়ীদের সুরক্ষায় শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন শক্তিশালীকরণের কোনো বিকল্প নেই।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘তামাক ক্যানসার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এসডিজির লক্ষ্য পূরণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।’
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর মাহফুজ কবীর বলেন, ‘কোম্পানিগুলো আইন শক্তিশালী করার সঙ্গে রাজস্ব আয় হারানোর যে যুক্তি দেখায়, তার কোনো ভিত্তি নেই। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের চিত্রে এটি প্রমাণিত। তবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের চিন্তা করতে হবে কীভাবে তামাক রাজস্বের নির্ভরতা কমিয়ে অন্য খাতগুলো থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে। এতে জনগণ ও সরকার উভয়ই লাভবান হবে।’
চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, ‘শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনোযোগ না দিয়ে রোগের কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. অনুপম হোসেন বলেন, ‘তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করছি। এটির স্বাস্থ্যক্ষতি তামাকের মতোই। আইন সংশোধনের মাধ্যমে এগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে।’
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার ও প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে প্ল্যাকার্ড হাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রতি সমর্থন জানান প্রত্যাশা ইয়ুথ ক্লাবের সদস্যরা। আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
প্রজ্ঞার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন।